মরগ্যান হাউসেল এর লেখা The Psychology of Money বইটিতে তিনি টাকা সংক্রান্ত মানুষের বিভিন্ন মানসিকতা, লোভ ও আনন্দের কথা বলেছেন, এবং বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে তার বক্তব্যকে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করেছেন।
খুব সংক্ষেপে সেই বক্তব্যগুলি নিজের ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করবো –
The Psychology of Money Bengali Summary
কেউই উন্মাদ নয় (No One’s Crazy) –
টাকা সম্বন্ধে আপনার যে ব্যক্তিগত ধারণা তা সমগ্র পৃথিবীর ওপর হয়তো মাত্র ০.০০০০০০০১% প্রভাব ফেলে কিন্তু পৃথিবী কিভাবে চলছে সেই সংক্রান্ত আপনার ধারণার ওপর ৮০% প্রভাব ফেলে।
টাকার ব্যাপারে নেওয়া কারোর সিদ্ধান্তকেই আপনি ভুল বলতে পারেন না, কারণ আপনি তার সম্বন্ধে জানেনই না, আপনার আর তার পরিস্থিতি আলাদা।
লেখক খুব সুন্দরভাবে বলেছেন বিভিন্ন প্রজন্মের লোকজন, বিভিন্ন পরিবারে বড়ো হয়ে ওঠে এবং তাদের উপার্জনের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন, তাদের প্রত্যেকের ধারণা ভিন্ন, তারা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বসবাস করে, সেই সকল অংশের অর্থনীতি ও কাজের সুযোগ ভিন্ন, এবং তাই তারা যা কিছু শেখে বা যে মানসিকতা গড়ে তোলে তাও ভিন্ন।
জীবন ও পৃথিবী সম্পর্কে সকলেরই ধারণা অন্যন্য, এবং প্রত্যেকেই দুনিয়াকে তার নিজের মতো করে দ্যাখে।
এই একই কথা টাকার ক্ষেত্রেও সত্য , তাই টাকা সম্বন্ধে অন্য্ কারোর নেওয়া সিদ্ধান্তকে আপনার পাগলামি বলে মনে হলেও তার কাছে হয়তো সেই সিদ্ধান্ত যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত।
আবার একইভাবে আপনি নিজে টাকার ক্ষেত্রে যে সকল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা দেখে অন্য্ কারোর কাছে বোকামি বলে মনে হতেই পারে।
আপনি টাকাপয়সা সংক্রান্ত যে সকল সিদ্ধান্ত নেবেন তা পুরোপুরি আপনার পরিস্থিতি ও লক্ষ্য অনুসারে নেওয়া উচিত কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং অন্যের ধারণা অনুযায়ী আর্থিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে।
(ভাগ্য ও ঝুঁকি) Luck & Risk –
কোনো কিছুই ততটা ভালো বা ততটা খারাপ নয় যতটা মনে হয়।
এই প্রসঙ্গে তিনি বিল গেটস এর সম্পর্কে একটি কাহিনী তুলে ধরেছেন –
যখন বেশিরভাগ ইউনিভার্সিটির বিদ্যার্থীরা কম্পিউটার কি তাই জানত না তখন eighth grade এ পড়া বিল গেটস কম্পিউটার এর access পেয়ে গিয়েছিলেন।
১৯৬৮ সালে সারা পৃথিবীতে অন্তত ৩০৩ মিলিয়ন শিক্ষার্থী ছিল যারা হাই স্কুলে পড়ত, তাদের মধ্যে ইউনাইটেড স্টেটস এর শিক্ষার্থী ছিল অন্তত ১৮ মিলিয়ন , তাদের মধ্যে অন্তত ২৭০০০০ জন থাকত ওয়াশিংটনে, তার মধ্যে সিয়াটেলে থাকা লোকের সংখ্যা ছিল ১০০০০০ এর কিছু বেশি, তার মধ্যে মাত্র ৩০০ জন মতো পড়ত সেই লেকসাইড স্কুলে যেখানে কম্পিউটার ছিল।
অর্থাৎ সারা বিশ্বের ৩০৩ মিলিয়ন শিক্ষার্থীর মাত্র ৩০০ জনের কাছে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ ছিল সেই সময়ে যার মধ্যে বিল গেটস ছিলেন একজন, এটা ভাগ্য ছাড়া আর কি ?
মাইক্রোসফট এর সাফল্যের পিছনে বিল গেটস ও পল্ অ্যালেন এর অবদানের কথা আজ সকলেই জানেন, কিন্তু এরা দুজন ছাড়াও এদের দলে এক তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন কেন্ট ইভান্স যিনি গেটস এর মতে তাদের মধ্যে সেরা ছিলেন এবং কম্পিউটারের বিষয়ে আগ্রহ ও পারদর্শিতায় বাকি দুজনের থেকে কোনো অংশে কম ছিলেন না।
এটা নিশ্চিত এবং অবশ্যম্ভাবী ছিল যে মাইক্রোসফট এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে গেটস ও অ্যালেন ছাড়াও কেন্টস ইভান্স ও অবশ্যই থাকতেন কিন্তু তা হয়নি কারণ হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পূর্বেই পর্বতারোহণে গিয়ে দুর্ঘটনায় কেন্ট মারা যান।
ইউনাইটেড স্টেটস এ প্রতিবছর যে সংখ্যক লোক পর্বতারোহণে যান তার মধ্যে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে মিলিয়নের মধ্যে একজনের অথচ সেই একজনই হলেন কেন্টস।
যেখানে মিলিয়নের মধ্যে একজন ছাত্র হয়ে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ পাওয়ার সৌভাগ্য বিল গেটস পেলেন সেই একইভাবে সমান দক্ষতা ও মেধাসম্পন্ন হয়েও বিল গেটস এর সাথে একইসঙ্গে দেখা স্বপ্ন পূরণ না করতে পেরে মিলিয়নের মধ্যে একজন দূর্ঘটনাগ্রস্ত হওয়ার দুর্ভাগ্য পেলেন কেন্টস।
আপনার ১০০ শতাংশ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আপনার কাঙ্খিত ফলাফল সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন না হওয়ার কারণ হলো যে সত্য তারা হলো ভাগ্য ও ঝুঁকি। এবং এরা কোনোভাবেই পরিমেয় নয়।
কখনই যথেষ্ট নয় (Never Enough) – যখন ধনীরাও উন্মাদের মতো আচরণ করে
কলকাতায় জন্মগ্রহণকারী রজত গুপ্তা একদম শূন্য থেকে শুরু করে ৪০ এর কাছাকাছি বয়সে গিয়ে McKinsey এর CEO হয়ে ওঠেন, ২০০৭ সালে তিনি সেখান থেকে অবসর নেন এবং ২০০৮ সালে তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
এই পরিমাণ টাকা দিয়ে তিনি যেভাবে ইচ্ছা জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু তিনি মিলিয়নিয়ার হয়েই থেমে থাকতে চাননি তিনি হতে চেয়েছিলেন বিলিয়নিয়ার।
তাই এরপরে তিনি Goldman Sachs এর বোর্ড অফ ডিরেক্টরস এর সদস্য হিসেবে যুক্ত হন, ২০০৮ সালে আর্থিক দুরবস্থায় এই সংস্হার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে এবং বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফে ঠিক করেন ৫ বিলিয়ন ডলার তিনি বিনিয়োগ করবেন এই সংস্থাকে বাঁচাতে।
এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বোর্ড মেম্বার হিসেবে গুপ্তা আগেই জেনে যান এবং এই চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কিছু আগেই তিনি রাজারত্নম নামের এক hedge ফান্ড ম্যানেজারকে ফোন করেন এবং ওই ফান্ড ম্যানেজার Goldman Sachs এর ১৭৫০০০ টি শেয়ার কিনে নেন।
এর কয়েক ঘন্টা পরে যখন জনগণের কাছে এই চুক্তির খবর গিয়ে পৌঁছয় এবং স্বাভাবিকভাবেই শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে, তখন তার ফলস্বরূপ কয়েকঘন্টায় রাজারত্নম মিলিয়নিয়ার হয়ে যান।
Insider ট্রেডিং এর অপরাধে রজত গুপ্তা ও রাজারত্নম এর জেল হয় এবং গুপ্তা তার এত বছরের অর্জিত সম্মান হারিয়ে ফেলেন, কারণ তিনি জানতেন না যে কতটা যথেষ্ট।
বিশেষ দ্রষ্টব্য – এই সমগ্র ঘটনাটি যথেষ্ট বিতর্কিত এবং উপরের কয়েকটি লাইন পরে রজত গুপ্তাকে কোনো অপরাধী ভেবে নেওয়ার আগে তার লেখা বই The Mind Without Fear ও অবশ্যই পড়বেন।
এভাবেই লেখক আরো এক ব্যক্তির উদাহরণ দিয়েছেন এবং বলেছেন আর্থিক দক্ষতার ক্ষেত্রে খুব কঠিন বিষয় হলো এমন একটি গোলপোস্ট বা লক্ষ্য নির্ধারণ করা যেখানে গিয়ে আপনাকে থামতে হবে, যখন আপনি মন থেকে জানবেন যে এটা যথেষ্ট।
জীবনে এমন কিছু জিনিস আছে যেগুলোর ক্ষেত্রে কখনই ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয় তাতে যতই লাভের সম্ভাবনা থাকুক না কেন। যেমন – সম্মান, খ্যাতি, স্বাধীনতা, শান্তি ইত্যাদি।
বিভ্রান্তিকর compounding (confounding compounding) –
Compounding হল পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য বিষয় যেখানে কোনো খুব সামান্য জিনিসও সময়ের সাথে সাথে compounding এর সাহায্যে বিশাল হয়ে ওঠে।
The Almanack Of Naval Ravikant বইতে লেখক বলেছেন যে compounding জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে কাজ করে তা সম্পর্ক হোক সম্পদ বা জ্ঞান।
আর টাকার ক্ষেত্রে তো তা অত্যন্তভাবে সত্যি।
ওয়ারেন বাফের সম্পর্কে লেখা বইয়ের সংখ্যা অজস্র, কিন্তু বাফের সম্পত্তি শুধুমাত্র বিনিয়োগের জন্য হয়নি, হয়েছে কারণ তিনি বিনিয়োগ অনেক কম বয়স থেকে করছেন।
বাফের সম্পত্তির সিংহভাগ তার বয়স ৫০ পার হবার পর হয়েছে compounding থেকে, যদি তিনি ৩০ বছরের পর থেকে বিনিয়োগ শুরু করতেন তাহলে আজ হয়তো আমরা কেউই তার নাম জানতাম না।
বিনিয়োগকারী হিসেবে তার দক্ষতা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই কিন্তু compounding এর আসল সূত্র হলো সময়, খুব কম লোকই দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগ করতে পারেন।
তাই সফল বিনিয়োগকারী হওয়ার জন্য আপনার বিরাট পরিমাণের কোনো রিটার্ন পাওয়ার দরকার নেই। আপনি একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ রিটার্ন দীর্ঘ সময় ধরে পেতে পারলেই compounding এর ফল দেখতে পাবেন।
সম্পদশালী হওয়া ও সম্পদশালী থাকা (Getting Wealthy Vs Staying Wealthy) –
সম্পদশালী হওয়ার অগনতি উপায় আছে কিন্তু সম্পদশালী থাকা ততটাও সহজ নয়।
১৮৭৭ সালে জন্মগ্রহণকারী Jesse livermore ছিলেন তার সময়ের অন্যতম সেরা স্টক মার্কেট ট্রেডার যিনি মাত্র ৩০ বছর বয়সেই ১০০ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ গড়ে তোলেন।
১৯২৯ এর অক্টোবর মাসে স্টক মার্কেটে মারাত্মক ধস নামে এবং খবরে জানা যায় ওয়াল স্ট্রীটের বহু speculator রা আত্ম্যহত্যা করেছে, লিভারমোর বাড়ি না ফেরায় এই খবরে তার স্ত্রী ডরোথি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং তার মা দুশ্চিন্তায় পাশের ঘরে লুকিয়ে পড়েন এবং লিভারমোর বাড়ি ফেরা মাত্র ডরোথি তার সন্তানদের নিয়ে তাকে কাঁদতে কাঁদতে স্বাগত জানান।
এই ঘটনায় লিভারমোর হতভম্ব হয়ে যান এবং তিনি পরিবারকে জানান যে স্টক মার্কেটের যে ধসে বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে সেই দিনেই তিনি প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়ে গেছেন।
যে দিন স্টক মার্কেটের ইতিহাসে কালো দিন বলে অভিহিত সেই দিনেই লিভারমোর পৃথিবীর ধনীতম ব্যক্তিদের একজন হয়ে ওঠেন।
সেই একই সময়ে আরেক মাল্টিমিলিয়নিয়ার রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার আব্রাহাম জার্মানস্কি নিখোঁজ হয়ে যান, খুব সম্ভবত সবকিছু খুইয়ে তিনিও আত্ম্যহত্যার পথই বেছে নিয়েছিলেন।
কিন্তু এখানেই গল্প শেষ নয়, ১৯২৯ এর ওই ঘটনায় লিভারমোর অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং প্রচুর পরিমাণ অর্থের ট্রেডিং করতে শুরু করেন এবং এইভাবে আরো চারবছর পর ১৯৩৩ সালে সর্বস্বান্ত ও লজ্জিত হয়ে তিনিও দুদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যান, তার স্ত্রী তাকে খুঁজতে বেরোন, তিনি ফিরে আসেন ঠিকই কিন্তু সেটা নিজেকে শেষ করে দেওয়ার জন্য।
লিভারমোর বা জার্মানস্কি দুজনেই সম্পদশালী হতে পেরেছিল, কিন্তু কেউই সম্পদশালী থাকতে পারেননি, দুজনেরই সর্বস্বান্ত হওয়ার মধ্যে শুধুমাত্র সময়ের কিছুটা ফারাক ছিল।
সম্পদশালী থাকার জন্য এটা মাথায় রাখা দরকার যে পূর্বের কোনো সাফল্যের যে বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ওয়ারেন বাফের বিনিয়োগ করার পদ্ধতি নিয়ে বহু চর্চা করা যেতে পারে, তিনি কিভাবে কি কি করেছেন তা অনেকেই জানতে চান, কিন্তু তার সাথে এটাও জানা দরকার যে তিনি কি কি করেননি।
তিনি কখনই দেনায় ডুবে যাননি, স্টক মার্কেটের বহু ধস তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন কিন্তু তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি শেয়ার বিক্রি করে দেননি, তিনি কোনোরকম অবাঞ্ছিত ঝুঁকি নেননি যাতে তার সম্মান নষ্ট হয়, তিনি কখনই একটিমাত্র কৌশলকে অবলম্বন করে বসে থাকেননি, এবং সর্বোপরি তিনি কখনই বিনিয়োগ বন্ধ করেননি বা বিনিয়োগ থেকে অবসর ও নেননি।
বড়ো রিটার্নের থেকেও বেশি দরকারি হলো আর্থিকভাবে সুরক্ষিত থাকা কারণ তবেই আপনি দীর্ঘ সময় বিনিয়োগরত থেকে compunding কে কাজে লাগাতে পারবেন।
যে কোনো বিষয়ে পরিকল্পনা থাকা খুব দরকার কিন্তু পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো পরিকল্পনা অনুযায়ী না চলার পরিকল্পনাও করে রাখা।
পরিকল্পনা তখনই কাজে লাগবে যদি ভবিষ্যৎ আপনার পরিকল্পনামাফিক চলে, কিন্তু বাস্তব হলো ভবিষ্যতে কখন কি ঘটতে চলেছে তা আমরা কেউই জানিনা।
তাই পরিকল্পনায় সবসময় কিছুটা margin of safety এবং Room for error বা ভুল করার মতো জায়গাও রাখা দরকার।
ধরুন আপনি আগামী দশ বছর অন্তত ১০% সুদের হার পাবেন সেই অনুযায়ী আর্থিক পরিকল্পনা করলেন, কিন্তু আপনার এমনভাবেই বিনিয়োগ বা সঞ্চয় করা দরকার যাতে ১০% এর বদলে যদি মাত্র ৪% ও সুদ পান তাতেও যেন আপনাকে কোনো অসুবিধায় না পড়তে হয়।
Tails You Win – আপনি অর্ধেক সময় ভুল হলেও ভাগ্য গড়ে তুলতে পারেন
যা কিছুই বড়ো, লাভজনক, বিখ্যাত বা প্রভাববিস্তারকারী হোক না কেন তা হলো tail events অর্থাৎ মিলিয়নের মধ্যে ঘটা একটা ঘটনা।
অন্যতম সেরা বিনিয়োগকারী পিটার লিঞ্চ বলেছিলেন আপনি ব্যবসায় অসাধারণ দক্ষতাসম্পন্ন হলেও আপনি ১০ এর মধ্যে ৬ বার সঠিক হবেন।
আপনি ঠিক বা ভুল সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো ঠিক হয়ে আপনি কত টাকা উপাৰ্জন করলেন আর ভুল হয়ে কত টাকা খোয়ালেন, আপনি অর্ধেক সময় ভুল হয়েও ভাগ্য গড়ে তুলতে পারেন।
স্বাধীনতা (Freedom) – টাকা কি আপনাকে সবরকমভাবে সুখী করতে পারে? একদমই না।
সম্পদশালী হতে গেলে কি কয়েকশো কোটি টাকা থাকা প্রয়োজন? তাও নয়।
আপনি প্রকৃত সম্পদশালী তখনই হবেন যখন আপনি নিজের মতো করে সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হলো সময়।
আর সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার এই ক্ষমতা আপনাকে টাকাই এনে দিতে পারে যাতে আপনি স্বাধীনতা পান।
আপনি কি করতে চান, কখন করতে চান, কিভাবে করতে চান, কার সাথে করতে চান, এবং কতক্ষন করতে চান এইসমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ যদি আপনার হাতে থাকে তবেই আপনি স্বাধীন।
Man in the car Paradox –
প্রায়শই লোকে সম্পদশালী হতে চায় অন্যের কাছে গুরুত্ব পাওয়ার জন্য, দামি বাড়ি বা গাড়ি এসবের মাধ্যমে তারা অন্যের কাছে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরতে চায়।
কিন্তু বাস্তব হলো আপনি যখন কোনো দামি গাড়ি চেপে যান তখন খুব কম লোকেই আপনাকে লক্ষ্য করে বা গুরুত্ব দেয়, তারা ওই গাড়িটাকেই দ্যাখে এবং নিজেদের মনে ওইরূপ সম্পদ অর্জনের স্বপ্ন দ্যাখে।
সুতরাং কোনো দামি বস্তু নয় যা আপনি বাস্তবে পেতে চান তা হলো সম্মান ও শ্রদ্ধা।
সম্পদ সেটাই যেটা খালি চোখে দেখা যায়না (Wealth is what you don’t see)
অন্যের কাছে নিজেকে ধনী প্রমাণ করার জন্য যদি আপনি পরিকল্পনাবিহীনভাবে খরচ করতে থাকেন তবে তা হলো সর্বস্বান্ত হওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায়।
অন্যের বাড়ি, গাড়ি বা জীবনযাত্রা দেখে প্রভাবিত হবেন না কারণ আপনি শুধু বাইরেটা দেখছেন ভেতরটা নয়।
কারো বিরাট বাড়ি দেখে ভাবছেন সে খুব ধনী? খোঁজ নিয়ে দেখুন সে কত টাকার হোম লোন নিয়ে বসে আছে।
কেউ দামি গাড়ি চড়ে যাচ্ছে দেখে ভাবছেন সে খুব আয়েশে আছে? খোঁজ নিলে জানবেন সে কার লোনের টাকা শোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়াতে লোকজনের বেড়ানো দেখে ভাবছেন তারা খুব ফুর্তিতে আছে? লোকেরা ঘুরতে যাওয়ার জন্য টাকা ধার করতেও আজকাল পিছপা হয় না।
তাই দামি বাড়ি, গাড়ি, গয়না, পোশাকআষাক এসব কিছুই সম্পদ নয়, সম্পদ সেটাই যেটা দেখা যায় না।
কোটিপতি হওয়া বলতে বহু মানুষই কোটি টাকা খরচ করার কথা ভাবে কিন্তু বাস্তব হলো একদম তার উল্টোটা।
আমরা অন্যকে দেখে শিখি তাই আমরা সম্পদ অর্জনের থেকে খরচ করা তাড়াতাড়ি শিখি, কারণ সেটা আমরা সকলকে করতে দেখি, কিন্তু যে তার সম্পদ বাড়িয়ে চলেছে তা আমরা বাইরে থেকে দেখতে পাইনা, তাই শিখতেও পারি না।
টাকা জমান (Save Money) –
সঞ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, লেখকের মতে কিছু লোক সঞ্চয় করে, কিছু লোকে ভাবে তাদের পক্ষে সঞ্চয় করা সম্ভবই না, আর কিছু জন মনে করে তাদের সঞ্চয়ের কোনো প্রয়োজনই নেই।
সম্পদ বৃদ্ধির জন্য আপনি কত হারে সুদ পাচ্ছেন বা আপনি কত টাকা উপাৰ্জন করেন তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি কত টাকা সঞ্চয় করছেন।
সঞ্চয় যে কেউ করতে পারে, প্রাথমিক চাহিদা পূরণের পর আপনার যে টাকা থাকে সেটা আপনি চাইলেই সঞ্চয় করতে পারেন, কারণ সেই টাকা আপনি যে যে কাজে খরচ করেন সেগুলো প্রয়োজন নয় আপনার শখ এবং সঞ্চয় করবো ভাবলে আপনি নিজেই নিজের চাহিদা কমাতে পারেন।
সঞ্চয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট কারণ খোঁজার দরকার নেই, আপনার জমানো এক একটা টাকা আপনাকে আপনার ভবিষ্যতের সময়ের নিয়ন্ত্রন এনে দিতে পারে, যা অমূল্য।
Reasonable > Rational –
আর্থিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে লেখক rational থাকার চেয়ে reasonable থাকা অধিক শ্রেয় বলে মনে করেছেন।
Surprise –
পৃথিবীতে ঘটে চলা সতত পরিবর্তনশীল বিভিন্ন ঘটনা হলো ইতিহাস, কিন্তু এই ইতিহাসকে অনুসরণ করেই ভবিষ্যতের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সবচেয়ে বড়ো ভুল।
১% এর ও কম মানুষ বা কোনো ঘটনা সমগ্র পৃথিবীকে ১০০% বদলে দিতে পারে , তাই ইতিহাসের কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কখনই ভবিষ্যতের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
পৃথিবী বিস্ময়কর এবং অতীতে ঘটা সমস্ত বিস্ময়কর ঘটনা থেকে আমাদের ভবিষ্যতের বাধার সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার এবং মনে রাখা দরকার কখন কি ঘটতে পারে তা আমরা কিছুই জানি না।
Room for Error –
এই ব্যাপারে লেখক আগেও বলেছেন, যে আপনি আপনার সঞ্চয় বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যাই পরিকল্পনা করুন না কেন সেখানে যেন সর্বদা কিছুটা ভুল করার মতো জায়গা থাকে।
অর্থাৎ সবকিছু যদি আপনার পরিকল্পনামাফিক নাও হয় তাতেও যেন আপনাকে অসুবিধায় না পড়তে হয়।
You’ll change –
ভবিষ্যতের আর্থিক পরিকল্পনা করা ততটাও সহজ নয় যতটা মনে হয়, কারণ সময়ের সাথে মানুষের ইচ্ছা, আকাঙ্খা এবং লক্ষ্যও পরিবর্তিত হতে থাকে।
মানুষ খুব খারাপ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, যে কোনো লক্ষ্য আমাদের কল্পনা করতে ভালো লাগে কিন্তু সত্যিই সেই লক্ষ্যে পৌঁছলে আপনি কতটা খুশি হবেন তা আগে থেকে বোঝা সম্ভব নয়।
এর কারণ হলো যখন আমরা কোনো লক্ষ্যের কথা কল্পনা করি তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা তার শুধুমাত্র ভালো দিকগুলো দেখি, সেখানে কি কি সমস্যা আসতে পারে সেগুলো ভাবতে পারি না।
ধরুন আপনি কোনো এক নামজাদা কোম্পানিতে চাকরি করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন, আপনার কল্পনা করে ভাল লাগছে যে আপনি ওই সংস্থার উচ্চপদে কর্মরত, আপনার নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি আছে এবং আপনি আর্থিক সচ্ছলতা পেয়ে গেছেন, এছাড়াও আপনি অন্যদের কাছে সম্মান ও পাচ্ছেন। এগুলো ভেবে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে তো ভালো লাগবেই
কিন্তু যেগুলো আপনি কল্পনা করতে পারছেন না তা হলো সত্যি ওই জায়গায় পৌঁছে আপনার কতটা কাজের চাপ ও স্ট্রেস থাকবে, আপনার আর্থিক সচ্ছলতা হয়তো থাকবে কিন্তু নিজের মতো করে কাটাবার সময় কি থাকবে ?
শুধু অর্থেই কি আপনি খুশি থাকবেন যদি আপনাকে নিজের পরিবারকে ছেড়ে থাকতে হয় ? সেই পরিস্থিতিতে আপনার কেমন লাগবে যদি প্রয়োজনের সময় আপনি আপনার বাবা মা এর কাছে না থাকতে পারেন ?
এছাড়াও এমন নানা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যা আপনি আগে থেকে কল্পনাও করতে পারেন না।
আর এই সমস্ত কিছুই আপনার ভবিষ্যতের আর্থিক পরিকল্পনায় বিরাট প্রভাব ফেলে। কারণ আপনি এবং আপনার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সর্বদাই বদলাতে থাকবে।
Nothing’s Free – .
প্রত্যেক জিনিসেরই মূল্য দিতে হয়, এই পৃথিবীতে বিনামূল্যের কিছুই নেই। ঠিক তেমনই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে মূল্য দিতে হয় তা হলো volatility ও অনিশ্চয়তা।
এই মূল্য অনেকেই দিতে চাননা কারণ এর থেকে যে রিটার্ন পাওয়া যাবে সেটা তৎক্ষণাৎ নয় আর আমরা সেটারই দাম দিতে চাই যেটা আমরা সঙ্গে সঙ্গে মূল্যের বিনিময়ে পাবো।
You and Me –
অন্য্ কেউ যতই আর্থিক বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন হোক না কেন, নিজের আর্থিক পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত কখনই অন্যের উপরে ছেড়ে দেবেন না, কারণ প্রত্যেকের জীবন আলাদা, লক্ষ্য, ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যগুলোও আলাদা।
The Seduction of Pessimism –
আশাবাদের থেকে হতাশাবাদ বেশি গুরুত্ব পায় কারণ সেটা বেশিরভাগ মানুষের কাছে কোথাও না কোথাও বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়।
When You’ll Believe Anything –
মানুষ শুকনো পরিসংখ্যানের থেকে আকর্ষণীয় গল্প শুনতে বেশি ভালবাসে এবং তাদের আর্থিক সিদ্ধান্তগুলিও গল্পের দ্বারা পরিচালিত হয়।
কোনো বিষয়ে যখন আপনি নিজে কিছু চান তখন আপনার সেই চাওয়াকে সমর্থন করে এমন ধরনের গল্পকে আপনি বেশি গুরুত্ব দেন এবং বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেন যদি বাস্তবে তা সত্যি নাও হয় তা সত্ত্বেও।
পৃথিবীর প্রতি আমাদের প্রত্যেকের ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি অসম্পূর্ণ কিন্তু সেই অংশকে আমরা নিজেদের মতো করে পূরণ করে নিই।
All together now –
এই অংশে লেখক সমগ্র বইয়ের মর্মার্থ তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং বলেছেন –
আর্থিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যখন আপনি সঠিক হবেন তখন নম্র থাকুন এবং যখন ভুল হবেন তখন শান্ত থেকে নিজেকে ক্ষমা করুন।
কারণ কখনই সেটা ততটা ভালো বা ততটা খারাপ নয় যতটা আপনার মনে হচ্ছে।
এই পৃথিবী বিরাট ও জটিল এবং এখানে ভাগ্য ও ঝুঁকি এমন দুই সত্যি যাদের আগে থেকে জানা যায় না, তাই নিজেকে বা অপরকাউকে বিচার করার আগে এদের কথা মাথায় রাখুন।
যখন আপনি বুঝবেন ভাগ্য বা ঝুঁকি আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই তখন আপনি সেই সকল বিষয়ে আরো ভালোভাবে মনসংযোগ করতে পারবেন যেগুলো আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে।
অহং কমান ও সম্পদ বাড়ান, আপনার অহংকার ও উপার্জনের মাঝের ফারাক ই হলো আপনার সঞ্চয় আর সম্পদ সেটাই যেটা চোখে দেখা যায় না।
আপনার অর্থকে এমনভাবে সামলান যাতে আপনি রাত্রে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন, যদি আপনি সফল বিনিয়োগকারী হতে চান তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনার বিনিয়োগের সময়কে দীর্ঘায়িত করা, আর এমনভাবে পরিকল্পনা করুন যাতে আপনার পরিকল্পনা মতো সবকিছু না হলেও আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।
অর্থকে কাজে লাগান নিজের সময়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ পেতে, কারণ নিজের সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আপনাকে অসীম সুখ এনে দিতে পারে।
অন্য্ কাউকে দেখানোর জন্য নয় খরচ করুন নিজের প্রয়োজনে, কারণ কোনো বস্তু নয় আপনি অন্যদের থেকে যেটা চান তা হলো সম্মান।
সঞ্চয় করুন, কোনো কারণ ছাড়াই সঞ্চয় করুন এবং নিজের আর্থিক পরিকল্পনায় সবসময় ভুল করার মতো জায়গা রাখুন।
ভবিষ্যতের জন্য নেওয়া কোনো আর্থিক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে মেনে নেবেন না কারন সময়ের সাথে সাথে পৃথিবী বদলাবে আর বদলাবে আপনার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ইচ্ছাগুলোও।
অন্য্ কারোর মতামতে নিজের আর্থিক পরিকল্পনা করবেন না, সকল মতামতকে সম্মান করুন কিন্তু সেটাই একদম সঠিক বলে ধরে নেবেন না, খুঁজে বের করুন কোনটা আপনার জন্য সঠিক হবে।
শেষ অংশে লেখক তার নিজের অর্থ সম্পর্কে বলেছেন কিন্তু যতটুকু সকলের কাজে লাগতে পারে তার সবটাই আমি এখানে নিজের মতো করে তুলে ধরলাম কিন্তু আসল বইটি আপনারা সংগ্ৰহ করে পড়তে ভুলবেন না।
Think and Grow Rich Bengali Summary
The Monk Who Sold His Ferrari – আপন ঐশ্বর্য্য ত্যাগ করা এক সন্ন্যাসী
Playing with FIRE (Financial Independence Retire Early) Book Summary In Bengali