যেকোনো ট্রপিক্যাল দেশের স্বাস্থ্য সমস্যার একটি বড়ো কারণ ভেক্টর বাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদূর্ভাব। ভারত, বাংলাদেশ সহ সমগ্র উপমহাদেশই যেহেতু কর্কট ক্রান্তি রেখার মধ্যে অবস্থিত তাই এই জায়গাগুলিতে মশা, মাছি, ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের সংখ্যাধিক্য বেশ কিছু অসুখের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
সেরকমই মশাবাহিত রোগও এখানকার জনজীবনের জন্য খুবই সমস্যার কারণ। তবে মশাবাহিত রোগের মধ্যে উপযুক্ত আবহাওয়ার কারণেই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া বিগত ১০ বছরে মারাত্মক রূপ ধারণ করছে।
আর একদম সাম্প্রতিক বছর গুলির মধ্যে ২০২১ ও ২০২২সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ গুলি এতো বিভিন্ন ধরণের হচ্ছে যে ডেঙ্গু বলে সনাক্ত করতে দেরি হওয়ার কারণে অকাল মৃত্যুও অন্যান্য বছর গুলির তুলনায় বেশি হচ্ছে।
বর্ষাকালের ভারী বর্ষণ শেষ হবার উপক্রম হতেই পুজোর পর থেকে কনকনে শীত না পড়া পর্যন্ত ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়াতে বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বছরের মধ্যে জুন-জুলাই থেকে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর দাপট খুবই বেড়ে যায়।
বর্তমানেও ডেঙ্গু সংক্রমণ এতোটাই বেড়ে গেছে যে প্রশাসন অবধি যথেষ্ট নড়ে চড়ে বসেছে তার কারণ শুধু সংক্রমণের হার বৃদ্ধি তা নয় বরং উল্লেখযোগ্য ভাবে মৃত্যু সংখ্যাও বাড়ছে এবং তা কম বয়সীদের ক্ষেত্রেও মারাত্মক আকার ধারণ করছে। “বয়স অল্প বলে শরীর সব রোগ সহ্য করে ঠিক উঠে পড়বে” এই আপ্তবাক্যটি কমবয়সী ডেঙ্গু আক্রান্তের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে।
তাই ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষিত থাকতে বা ডেঙ্গু হয়ে থাকলে সাধারণভাবে তা মোকাবিলা করার জন্য প্রতিটা মানুষের যে তথ্যগুলি জানা আবশ্যিক সেই নিয়েই আজকের এই নিবন্ধ, তাই দেখে নেওয়া যাক ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ কি? কি কি পদ্ধতি অবলম্বন করলে ডেঙ্গু কে রোখা যেতে পারে? এবং ডেঙ্গু হয়েছে কিনা বুঝবেন কিভাবে ও ডেঙ্গু হলে কি কি করণীয়।
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক ডেঙ্গু রোগের কারণ কি ?
ডেঙ্গু ভাইরাস আক্রান্ত এডিস ইজিপ্টাই মশা কামড়ালে ডেঙ্গু রোগ হয়।
কোন মশা কামড়ালে ডেঙ্গু রোগ হয়?
এডিস ইজিপ্টাই মশা কামড়ালে ডেঙ্গু রোগ হয়।
যদিও যেকোনো এডিস ইজিপ্টে মশা কামড়ালেই যে ডেঙ্গু রোগ হয় এমন কিন্তু নয়, এডিস মশা টি নিজে যদি ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা ইনফেক্টেড ( আক্রান্ত ) থাকে তবেই সেই মশা টি কোনো মানুষকে কামড়ালে সুস্থ মানুষটির ডেঙ্গু রোগ হয়।
মশা কামড়ানোর কতদিন পর ডেঙ্গু হয় ?
ডেঙ্গু মশা কামড়ানোর ৪-১০ দিন বাদে আক্রান্ত মানুষটির শরীরে ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা যায়।
এডিস মশা কামড়ালে কি ডেঙ্গু হয় ?
না শুধু এডিস মশা কামড়ালে ডেঙ্গু হবে না, যদি মশাটি নিজে ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে তবেই হবে ডেঙ্গু।
ডেঙ্গু মশা কামড়ানোর সময় কখন ?
তত্ত্বগত ধারণা অনুযায়ী “ডেঙ্গু মশা কখন কামড়ায় ?” এই প্রশ্নের উত্তরে এতো দিন অবধি বলা হতো সূর্যোদয়ের ২ ঘন্টা পর অবধি এবং সূর্যাস্তের কিছু ঘন্টা আগে থেকে সূর্যাস্ত অবধি, ও দিনের বেলায় এই মশাদের বাড়বাড়ন্ত দেখা যায় এবং তখনই এই মশা রা কামড়ায়।
যদিও বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে সব ক্ষেত্রে যে এই নিয়ম চলছে তা একেবারেই নয়। তাই মশা হইতে সব সময় ই সাবধান থাকুন।
ডেঙ্গু মশা ছবি – /ডেঙ্গু মশার ছবি-
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ / ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কি কি ?
প্রায় ১০৩-১০৪ জ্বর
প্রচন্ড মাথার যন্ত্রনা
মাংসপেশীতে, গাঁটে -গাঁটে ব্যাথা, হাড়ে ব্যাথা
চোখের ভিতরে ব্যাথা
পেটে ব্যাথা
বমি করা
গায়ে rash বেরোনো ইত্যাদি।
এখানে উল্লিখিত প্রতিটি লক্ষণের সবগুলি যে যেকোনো ডেঙ্গু আক্রান্তের দেখা যাবে তা নয় , খুব জ্বরের সাথে যেকোনো একটি উল্লিখিত উপসর্গ দেখা গেলেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবেই।
ডেঙ্গু হলে কখন হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ?
প্রচন্ড পেট ব্যাথা হলে , ঘন ঘন বমি হতে থাকলে , শরীরে কোনো জায়গা থেকে বিনা কারণে রক্তক্ষয় হলে, শ্বাসকষ্ট হলে অথবা ৬ ঘন্টার বেশি প্রস্রাব না হলে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর কত দিন থাকে ?
৩-৫ দিন ডেঙ্গুর জ্বর থাকে। আর ২-৭ দিন ডেঙ্গু রোগের লক্ষন গুলি দেখা যায়।
ডেঙ্গু জ্বর কি ছোঁয়াচে রোগ ?
ডেঙ্গু আক্রান্ত কারোর সংস্পর্শে থাকলে বা ছুঁলে, বা এক ই থালা বাটি ব্যবহার করলে কোনো সুস্থ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হবে না। কিন্তু যদি কোনো মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত কারোর রক্ত খেয়ে এসে কোনো সুস্থ মানুষের রক্ত খেতে আসে তখন সুস্থ লোকটি ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে রক্তের কোন উপাদান কমে যায় ?
প্লেটলেট বা অণুচক্রিকার সংখ্যা কমে যায়।
ডেঙ্গু জ্বর হলে কি খেতে হবে ?/ডেঙ্গু রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা-
১) প্রচুর পরিমানে জল খেতে হবে, সাধারণত সুস্থ অবস্থায় দিনে যত জল খান , ডেঙ্গু হলে তার থেকে কমপক্ষে ১ লিটার বেশি জল খেতে হবে।
জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে হবে, অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবেনা।
সুষম খাবার খেতে হবে যা সহজে হজম হয়ে যায়, তেল-ঝাল-মশলা দেওয়া খাবার এড়িয়ে চলতে হবে, কারণ পেট খারাপ হয়ে গেলে এই অবস্থায় খুব মুশকিল হতে পারে।
প্রচুর পরিমানে ফলের রস বা ফল খেতে হবে।
ডেঙ্গু হলে কি কি ফল খেতে হবে ?
ডেঙ্গুতে সব ফল খেতে পারা যায়।
যেহেতু ডেঙ্গুর প্রধান সমস্যা হল প্লেটলেট কাউন্ট কমে যাওয়া তাই এমন খাবার অতি অবশ্যই খাওয়া উচিত যা প্লেটলেট এর সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে। সেরকম কয়েকটি খাবার হলো –
পেঁপে পাতার রস ( এটিও প্লেটলেট এর সংখ্যা বাড়াতে খুব ই উপযোগী হিসেবে মনে করা হয় কিন্তু সেটা সঠিক পরিমানে না খেলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে তাই অতি অবশ্যই পেঁপে পাতার রস খেতে হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন )
পেঁপে ( পাকা পেঁপে ফল হিসেবে খান , কাঁচা পেঁপে সেদ্ধ করে বা তরকারি তে বা ঝোলে খেতে পারা যাবে )
দুধ – দুধে ক্যালসিয়াম বেশি পরিমানে আছে তাই এটি রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে এবং প্লেটলেট বাড়ায়।
ডালিম – ডালিমের বীজগুলি আয়রন সমৃদ্ধ হওয়ায় এটিও প্লেটলেট বাড়াতে সাহায্য করে, তাই অতি অবশ্যই ডালিম ফল হিসেবে খাওয়া উপকারী।
কুমড়ো ও খুব ভালো কাজ করে প্লেটলেট বাড়াতে কারণ এতে ভিটামিন এ আছে।
ভিটামিন B ৯ সমৃদ্ধ খাবার, যেমন পালং শাক, কমলা লেবু, বিনস, শস্য জাতীয় খাবার প্রতিদিনের খাবারে থাকা উচিত।
ডেঙ্গু হলে কোনো খাবার খাওয়ার উপরে কোনো নিষেধাজ্ঞা সেইভাবে আরোপ করার মতো কিছু নেই কিন্তু সুষম খাবার খাওয়াই শ্রেয়।
ডেঙ্গু রোগের টেস্ট কি ?
ডেঙ্গু রোগের পরীক্ষা – করতে NS ১ টেস্ট করা হয় । কোনো মানুষ ডেঙ্গু দ্বারা আক্রান্ত হলে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ প্রকাশের প্রথম দিকেই ডেঙ্গু সনাক্তকরণের জন্য NS ১ টেস্ট করানো হয়।
এটি ডেঙ্গু ভাইরাস এর একটি নন স্ট্রাকচারাল প্রোটিন যা কোনো মানুষ ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে আক্রান্তের রক্তে মেলে। এর সাথে প্লেটলেট কাউন্ট ও দেখে নেওয়া হয়।
ডেঙ্গু মশা দেখতে কেমন ?
উপরে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশার নাম এডিস মশা আর তাই ডেঙ্গু মশা চেনার উপায় খুঁজতে হলে এডিস মশার সম্পর্কেই জানতে হবে –
এডিস মশার বৈশিষ্ট্য হলো –
সাইজে খুব ছোট হয়।
শরীরে ও হাতে পায়ে কালো সাদা দাগ থাকে।
কামড়ালে বুঝতে পারা যায়না।
সাধারণত পা এ বা কনুই এর কাছে কামড়ায়।
ডেঙ্গু মশার উৎপত্তি কোথায় ?
ডেঙ্গু মশা যেকোনো আবদ্ধ পরিষ্কার জলে ডিম্ পাড়ে। ফুলের টব , পরিত্যক্ত টায়ার , ভাঙা কাপ , জল যায়না এমন নর্দমা এদের জন্মানোর উপযুক্ত স্থান।
ডেঙ্গু কেন মানুষের জন্য বিপদজনক?
ডেঙ্গুর জ্বরের প্রভাবে মানুষের রক্তে থাকা প্লেটলেট সংখ্যা মারাত্মক ভাবে কমতে আরম্ভ করে আর এটাই সবচেয়ে বিপদজনক। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে প্লেটলেট সংখ্যা থাকার কথা দেড় লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ ৭০ হাজার এর মধ্যে, সেখানে ডেঙ্গু হলে প্লেটলেট যদি এক লক্ষের নিচে নেমে যায় তখনি তা প্রাণঘাতী হতে পারে। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ ও হতে পারে।
যাদের একবার ডেঙ্গু হয়ে গেছে তাদের আরো সতর্ক হওয়া উচিত কারণ ডেঙ্গু ভাইরাস প্রায় ৪ রকমের তাই ৪ বার ডেঙ্গু হতে পারে, আর একবার ডেঙ্গু হলে দ্বিতীয়বার বার ডেঙ্গু হবার সময় জটিলতা মারাত্মক পারে। তাই যারা আগেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তারা কোনো মতেই যাতে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত না হন তার দিকে খেয়াল রাখুন।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে করণীয় কি কি ?
কারোর জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়ান, অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবেনা। ২ দিনেই জ্বর না কমলে ডাক্তারের কাছে যান, ডেঙ্গু টেস্ট করে নিন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
৫ দিন ফেলে রাখবেন না কারণ এতদিন ডেঙ্গুর যে যে উপসর্গ দিয়ে ডেঙ্গু চিহ্নিত করা হতো সেগুলি বর্তমানে এখন আর দেখা যাচ্ছেনা, অর্থাৎ ভাইরাস তার গতি প্রকৃতি বদলাচ্ছে, তাই ডেঙ্গু চিনতে দেরি হওয়াতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে , তাই ডেঙ্গু টেস্ট করান যতটা তাড়াতড়ি সম্ভব ।
সঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে ডেঙ্গু রোগী কয়েকদিনের মধ্যেই ঠিক যায়, কিন্তু দুর্বলতা থাকে।
বাড়ির আশেপাশে জল জমতে দেবেন না, পরিষ্কার আবদ্ধ জলে ডেঙ্গু মশা ডিম্ পাড়ে। সেই ডিম্ থেকে যে বাচ্চা মশা তৈরী হয় তারাও ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে তাই সেই মশা গুলি কামড়ালেও ডেঙ্গু হবে।
যদি বাড়িতে কোনো ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি থাকে তাহলে তাকে অতি অবশ্যই মশারির ভিতর রাখুন। জ্বর আসা থেকে কম পক্ষে ৫-৬ দিন ডেঙ্গু আক্রান্তকে মশারির ভিতরে রাখুন, আর নিজেরাও শোয়ার সময় ( যখনই শুন তা সকাল হোক বা দুপুর বা রাত) মশারির ভিতর শুন।
বাড়িতে যদি খুব মশার উৎপাত থাকে তাহলে অতি অবশ্যই এই ক দিন মশা মারার বা তাড়ানোর সব পদ্ধতি অবলম্বন করুন, যেমন গুড নাইট, অল আউট জাতীয় মশা বিতাড়নের তেল, মশাতাড়ানোর স্প্রে ব্যবহার করতেই হবে। মশা মারার ব্যাট ব্যবহার করুন।
আসলে ডেঙ্গুর উপসর্গ ধরা পড়ার আগেই কিন্তু যে ব্যক্তির ডেঙ্গু হয়েছে তার রক্ত যদি কোনো মশা খেয়ে থাকে তাহলে সে যদি সুস্থ মানুষকে কামড়ায় তাহলে ডেঙ্গু অন্য দেরও হয়ে যাবে, তাই যেকোনো মূল্যে মশা তাড়ান।
এতো যারা বাড়িতে থাকবেন তাদের করণীয় , কিন্তু যাদের কাজকর্মের জন্য বেরোতে হয়, বাসে , ট্রেনে , স্টেশনে যেতে হয়, ফিল্ডে নেমে কাজ করতে হয়, তারা তো আর সব জায়গার মশা মারতে মারতে যাবেন না, তাই তাদের একমাত্র উপায় মশা গায়ে বসতে না দেওয়া, তাই জন্য মশা তাড়ানোর ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন রোজ।
সেরকম কয়েকটি মশা তাড়ানোর ক্রিম হল-
বাচ্চা দের জন্য -০-৫ বছরের জন্য
রোল অন –
মশা তাড়ানোর তেল –
সুগার কমানোর ঘরোয়া উপায়গুলি কি কি?