ডাবের জল বা ডাবের পানির কথা বলতে গেলে প্রথমেই মাথায় আসে সমুদ্রের ধারে বিচে ঘুরতে গিয়ে চোখে সানগ্লাস পরে ঠোঁটে পাইপ লাগিয়ে হাতে ইয়া বড়ো ডাব হাতে করে বসে বসে আয়েশ করে খাবার কথা।
যদিও শহরে ও গ্রামে সব জায়গাতেই ডাব খানিক বিক্রি হয় বটে কিন্তু হয় সেগুলির দাম বেশি আর নয়তো দাম অনুযায়ী ওই ঘুরতে গিয়ে সী বিচে যেরকম ডাবের পানি আমরা পান করি সেরকম গুণমানের হয়না,
আর নাহলে ডাব কিনতে সেই বাজারে যেতে হয় অর্থাৎ বস্তুটি পাড়ার মুদির দোকানে কেনার মতো সহজলভ্য নয়।
তাই কোকাকোলা, মাজা জাতীয় অতীব ক্ষতিকর added সুগার যুক্ত পানীয় যত সহজে বিক্রি হয় ডাবের পানি অত বিক্রি হয়না।
তাই ডাবের পানির খদ্দের তারাই যারা ডাবের পানির উপকারিতা সম্বন্ধে জানেন ও তা মানেন।
কিন্তু এই আয়েশ করে পান করার পানীয়টির গুণাবলী শুনলে সত্যি চমকে যেতে হয়।
রোজ সম্ভব না হলেও যাদের কাছে ডাবের দোকানির দেখা পাওয়া খুব অসম্ভব নয় তারা যদি যেরকম মুদির দোকান থেকে added সুগার যুক্ত পানীয় পান করেন সেগুলির বদলে যদি সপ্তাহে অন্তত ১ দিন বা ২ দিন ডাবের পানি পান করেন তাহলে নিজের শরীরের ই উপকার হবে।
১০০ গ্রাম ডাবের জলে কি কি পুষ্টিগুণ বর্তমান (ডাবের পানির পুষ্টিগুণ) –
এক কাপ ডাবের জলে ( প্রায় ২৫০ মিলিঃ ) থাকে ( ডাবের পানির উপাদান) –
- Calories: 44
- Protein: 0.5 grams
- Fat: 0 grams
- Potassium: 0.57 grams
- Sodium: 0.24 grams
- Carbohydrates: 10.4 grams
- Fiber: 0 grams
- Sugar: 9.6 grams
এবার দেখা নেওয়া ডাবের পানির উপকারিতা কী কী ?
১) শরীরের মাংসপেশী ও নার্ভাস সিস্টেম কে সঠিক ভাবে কাজ করতে সাহায্য করে –
ডাবের পানির মধ্যে প্রচুর পরিমানে ইলেক্ট্রোলাইটস আছে। ইলেক্ট্রোলাইটস হলো পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম জাতীয় খনিজ পদার্থ বা তার লবন, যেগুলি জলের সাথে গুলে গেলে পসিটিভ বা নেগেটিভ ইলেকট্রিক চার্জ সমন্বিত আয়নে রূপান্তরিত হয়।
এই ইলেক্ট্রোলাইটস গুলি আমাদের শরীরের মাংসপেশি ও নার্ভ এর কর্মপদ্ধতিকে সম্পূর্ণ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও আমাদের শরীরের প্রতিটা কোষের বাইরে ও কোষের ভিতরের জলের ভারসাম্য রক্ষা করতেও সাহায্য করে।
২) শরীরের জলের ভারসাম্য রক্ষা করতে ডাবের পানি-
আমাদের শরীরের প্রায় ৬০% হলো জল। তাই শরীরের জলের ভারসাম্য বজায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অনেকসময়ই মাংসপেশী তে টান ধরে।
আর এটার বেশিরভাগই হয় শরীরে পর্যাপ্ত জলের যোগান না থাকলে বা জলে সঠিক পরিমানে মিনারেলস না থাকলে। আর তাই যাদের এরকম সমস্যা প্রায়ই হয় তারা ডাবের জল খেলে খুবই উপকার পাবেন।
৩) ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণ করে ও স্ট্রোক এর সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে –
ডাবের জলে আছে প্রচুর পরিমানে পটাসিয়াম। ডাবের জলে যে পরিমান সোডিয়াম আছে তার চেয়ে অনেক বেশি আছে পটাসিয়াম।
আর আমরা সবাই জানি সোডিয়াম ব্লাড প্রেসার বাড়িয়ে দেয় তাই নিয়মিত ডাবের জল খেলে ব্লাড প্রেসার কে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে ও স্ট্রোক এর সম্ভাবনা ও কমিয়ে দেবে।
৪) হার্ট কে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে –
বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে পটাশিয়াম সমন্বিত খাবার হার্ট কে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে তাই যেহেতু ডাবের জলে প্রচুর পটাসিয়াম আছে তাই ডাবের পানির গ্লাসে চুমুক দিন আর হৃদয় কে রাখুন সুস্থ ও তরতাজা।
৫) মানসিক চাপ দূর করতেও ডাবের পানি –
ডাবের জলে থাকে প্রচুর অ্যামিনো অ্যাসিড। অ্যামিনো অ্যাসিড হলো সেই ক্ষুদ্রতম কণা যেগুলি প্রোটিন ভাঙলে তৈরী হয়। বা বলা যায় অনেক গুলি অ্যামিনো অ্যাসিড পরপর যুক্ত হয় তৈরি করে প্রোটিন।
এই অ্যামিনো অ্যাসিড আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে ও অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে যে মানসিক স্ট্রেস তৈরী হয় তা দূর করতে সাহায্য করে।
৬) রক্তে সুগারের মাত্রা কমায় –
ডাবের পানি তে আর এক খনিজ যা প্রচুর আছে তা হলো ম্যাগনেসিয়াম। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে ম্যাগনেসিয়াম আমাদের শরীরের ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে তাই যাদের এখনো ব্লাড সুগার মাত্রা ছাড়ায়নি, তাদের যাতে সুগার না আসে তার জন্য ডাবের জল খেতে পারেন।
এছাড়াও যারা টাইপ ২ ডায়াবেটিস এর রোগী তারা ডাক্তার বাবুর পরামর্শ মতো ডাবের জল খেতে পারেন।
সতর্কীকরণঃ – যাদের ইতিমধ্যেই ব্লাড সুগার অতিরিক্ত তারা ডাবের জল খাবেন কিনা তা ডাক্তার বাবুর পরামর্শ নিয়ে তবেই খাবেন কারণ ডাবে আছে কার্বোহাইড্ৰেট যা ব্লাড glucose কে বাড়িয়ে দেয়।
৭) কিডনি স্টোন কে প্রতিহত করতে পারে –
একটি রিসার্চ অনুযায়ী কিডনি স্টোন তৈরী হওয়া কে বন্ধ করতে ডাবের জল সাহায্য করতে পারে কারণ মানুষের বেশিরভাগ কিডনি স্টোন হয় অক্সালেট ও সাইট্রেট জাতীয়। আর ডাবের জল এগুলি প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে।
৮) ডাবের জলে অনেক পরিমানে সাইটোকাইনিন থাকে যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তোলে।
৯) আমরা সকলেই জানি ফ্রেশ ডাবের জলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে যার কাজ হলো বিপাকক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন মুক্ত মূলক যেগুলি আমাদের শরীরের কোষের ক্ষতি করে সেগুলি কে শরীর থেকে দূর করে দিতে সাহায্য করে।
১০) ত্বক ভালো রাখতে ডাবের জলের কোনো তুলনা নেই কারণ আমরা সবাই জানি শরীরে জলের ও খনিজের ভারসাম্য ঠিক থাকলে আমাদের ত্বক ও থাকবে তরতাজাতাই, স্কিন গ্লো করতে হলে অতি অবশ্যই ডাবের পানি পান করুন।
এছাড়াও ডাবের জল ওজন কমাতে, হজমতন্ত্র ভালো রাখতে সাহায্য করে।
আর কোনো প্রসেস করা ডাবের জল খাবার দরকার নেই কারণ প্রসেস করা কোনও কিছু রোজ পান করলে তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। তাই রাস্তায় ডাব ওলা দেখতে পেলেই একটা পাইপে করে ডাবের জলে চুমুক দিন।
খালি পেটে ডাবের পানির উপকারিতা
বেশ কিছু লোকের মতামত অনুযায়ী খালি পেটে ডাবের পানি খাওয়া খুবই নাকি উপকারী কারণ ডাবের পানির মধ্যেকার নিউট্রিএন্টস তাহলে বেশি ভালো করে কাজ করে। কিন্তু কিছু পুষ্টিবিদদের মতে সকালে উঠে খালি পেটে ডাবের পানি পান করা মোটেই ভালো নয় কারণ নিচে বর্ণিত হল–
১. সকালে উঠে খালি পেটে ডাবের পানি পান করলে পেটের নানারকম সমস্যা তৈরি হতে পারে।
২. অ্যাসিডিটি, বদহজম, গ্যাসের সমস্যাও দেখা দেয়।
৩. উপরন্তু খালি পেটে এই পানীয় খেলে এর মধ্যে থাকা কোনও উপাদানই শরীর গ্রহণ করতে পারে না তাই পুষ্টিও পাওয়া যায় না। অতএব খালি পেটে ডাবের পানি পান না করাই শ্রেয়।
গর্ভাবস্থায় ডাবের পানির উপকারিতা
১. গর্ভাবস্থায়, ডাবের পানি শরীরে জলের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে । যদিও সাধারণ জল পর্যাপ্ত পরিমানে পান করলেই শরীরে জলের ভারসাম্য রক্ষা হয়, তার জন্য সাধারণ জলের পরিবর্তে ডাবের জল খাওয়ার কোনো দরকার নেই, কারণ এই দুইয়ের কার্যকারিতা জলের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে একই আর তার উপর ডাবের পানির তুলনায় সাধারণ পানি আরো সস্তা।
২. গর্ভাবস্থায় অনেকের সকালে যে বমি বমি ভাব ও দুর্বলতা অনুভূত হয়, ডাবের পানি তা কমাতে সাহায্য করে।
৩. এই সময় অনেকের অ্যাসিডিটির সমস্যা হয়, এই পানীয় এই সমস্যার খানিক কমাতে সাহায্য করে।
৪. সন্তানসম্ভবাদের অনেকের ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাবার প্রবণতা এই সময় দেখা যায়, তাদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ কমাতে এই পানীয় সাহায্য করে কারণ এতে আছে পটাশিয়াম আর আমরা সবাই জানি পটাশিয়াম রক্তচাপ কমানোর জন্য কার্যকরী।
৫. এছাড়াও, এই সময়ে ভ্রূণের সার্বিক বিকাশের জন্য বেশ কিছু নিউট্রিএন্টস এর প্রয়োজন হয়, ডাবের পানি এই সব নিউট্রিএন্টস এর ভালো সরবরাহ করতে পারে।
ডাবের পানি সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন
ডাবের পানিতে কোন হরমোন পাওয়া যায় ?
সাইটোকিনিন (Cytokinin)।
ডাবের পানি ইংরেজি কি ?
Green Coconut Water / Juvenile Coconut Water.
দীর্ঘদিন ডাবের পানি সংরক্ষণের উপায় কী?
ফ্রিজে ডাবের জল ১-২ দিন সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন, কোনো মোটেই তার চেয়ে বেশি দিন রাখবেন না। আর প্যাকেট জাত ডাবের পানি না খাওয়াই শ্রেয় কারণ যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য এতে প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে যা আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
টানা ৭ দিন ডাবের পানি খেলে কি হয় ?
ডাবের পানি পান করার যা উপকারিতা আছে সেগুলিই হয়।