রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা
ক)
বিনা সাজে সাজি দেখা দিয়েছিলে কবে,
আভরণে আজি আবরণ কেন তবে।
ভালোবাসা যদি মেশে আধাআধি মোহে
আলোতে আঁধারে দোঁহারে হারাবো দোঁহে
ধেয়ে আসে হিয়া তোমার সহজ রবে ,
আভরণ দিয়া আবরণ কেন তবে।.
ভাবের রসেতে যাহার নয়ন ডোবা
ভূষণে তাহারে দেখাও কিসের শোভা।
কাছে এসে তবু কেন রয়ে গেলে দূরে —
বাহির-বাঁধনে বাঁধিবে কী বন্ধুরে ,
নিজের ধনে কি নিজে চুরি করে লবে।
আভরণে আজি আবরণ কেন তবে।
খ )
আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িবনা ধরনীতে
মুগ্ধ ললিত অশ্রু গলিত গীতে।
পঞ্চশরের বেদনামাধুরী দিয়ে
বাসররাত্রি রচি ব না মোর প্রিয়ে –
ভাগ্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে ভিক্ষা না যেন যাচি।
কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয় তুমি আছ আমি আছি। .
উড়াব ঊর্ধে প্রেমের নিশান দুর্গম পথ মাঝে
দুর্দম বেগে দুঃসহতম কাজে।
রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব –
চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব।
পাড়ি দিতে নদী হাল ভেঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি ,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।
দুজনের চোখে দেখেছি জগৎ , দোঁহারে দেখেছি দোঁহে –
মরুপথ তাপ দুজনে নিয়েছি সহে।
ছুটি নি মোহন মরীচিকা-পিছে-পিছে ,
ভুলাইনি মন সত্যেরে করি মিছে-
এই গৌরবে চলিব এ ভবে যত দিন দোঁহে বাঁচি।
এ বাণী প্রেয়সী, হোক মহীয়সী ‘তুমি আছ আমি আছি ‘..
গ)
পূর্ণ প্রাণে চাবার যাহা রিক্ত হাতে চাসনি তারে ,
সিক্ত চোখে যাস নি দ্বারে। .
রত্ন মালা আনবি যবে মাল্যবদল তখন হবে –
পাতবি কি তোর দেবীর আসন শূন্য ধূলায় পথের ধারে। .
বৈশাখে বোন রুক্ষ যখন , বহে পবন দৈন জ্বালা ,
হায়রে তখন শুকনো ফুলে ভরবি কি তোর বরণ ডালা।
অতিথিরে ডাকবি যবে ডাকিস যেন সগৌরবে ,
লক্ষ শিখায় জ্বলবে যখন দীপ্ত প্রদীপ অন্ধকারে। .
ঘ)
যে ছায়ারে ধরব বলে করেছিলাম পণ
আজ সে মেনে নিলো আমার গানেরই বন্ধন।
আকাশে যার পরশ মিলায় শরৎ মেঘের ক্ষণিক লীলায়
আপন সুরে আজ শুনি তার নূপুরগুঞ্জন।
অলস দিনের হাওয়ায়
গন্ধখানি মেলে যেত গোপন আসা-যাওয়ায়।
আজ শরতের ছায়ানটে মোর রাগিণীর মিলন ঘটে ,
সেই মিলনের তালে তালে বজায় সে কঙ্কন।
ঙ )
যেন প্রেম চির ঋণী আপনারই হরষে , যেন প্রিয়ে
সব পাপ ক্ষমা করি ঋণ শোধ করে সে।
কলঙ্ক যাহা আছে দূর হয় তার কাছে ,
কালিমার ‘পরে তার অমৃত সে বরষে।
চ)
তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে
আমায় শুধু-ক্ষণেক তরে।
আজি হাতে আমার যা – কিছু কাজ আছে
আমি সাঙ্গ করব পরে।
না চাহিলে তোমার মুখপানে
হৃদয় আমার বিরাম নাহি জানে ,
কাজের মাঝে ঘুরে বেড়াই যত
ফিরি কূলহারা সাগরে।
বসন্ত আজ উচ্ছাসে নিঃশ্বাসে
এলো আমার বাতায়নে।
অলস ভ্রমর গুঞ্জরিয়া আসে,
ফেরে কুঞ্জের প্রাঙ্গণে।
আজকে শুধু একান্তে আসীন
চোখে চোখে চেয়ে থাকার দিন ,
আজকে জীবন-সমর্পণের গান
গাব নীরব অবসরে।
ছ)
অজানা খনির নতুন মণির গেঁথেছি হার,
ক্লান্তিবিহীনা নবীন বীণায় বেঁধেছি তার।
যেমন নূতন বনের দুকূল , যেমন তেমন আমের মুকুল ,
মাঘের অরুণে খোলে স্বর্গের নূতন দ্বার ,
তেমনি আমার নবীন রাগের নব যৌবনে নব সোহাগের
রাগিণী রচিয়া উঠিল নাচিয়া বীনার তার।
যে বাণী আমার কখনো কারেও হয়নি বলা
তাই দিয়ে গানে রচিব নূতন নৃত্যকলা।
আজি অকারণ বাতাসে বাতাসে যুগান্তরের সুর ভেসে আসে,
মর্মরস্বরে বনের ঘুচিল মনের ভার।
যেমনি ভাঙিল বাণীর বন্ধ উচ্ছসি উঠে নূতন ছন্দ ,
সুরের সাহসে আপনি চকিত বীণার তার।
জ )
আমারে করো তোমার বীনা , লহ গো লহ তুলে।
উঠিবে বাজি তন্ত্রীরাজি মোহন অঙ্গুলে।
কোমল তব কমল করে , পরশ করো পরান -‘পরে ,
উঠিবে হিয়া গুঞ্জরিয়া তব শ্রবণমূলে।
কখনো সুখে কখনো দুখে কাঁদিবে চাহি তোমার মুখে ,
চরণে পড়ি রবে নীরবে রহিবে যবে ভুলে।
কেহ না জানে কি নব টানে উঠিবে গীত শুন্য-পানে ,
আনন্দের বারতা যাবে অনন্তের কূলে।
ঝ)
কাহার গলায় পরাবি রতনহার ,
তাই কি বিনয় লাগালি যতনে নুতন তার।
কানন পরেছে শ্যামল দুকূল , আমের শাখাতে নুতন মুকুল ,
নবীনের মায়া করিল আকুল হিয়া তোমার।
যে কথা তোমার কোনো দিন আর হয় নি বলা
নাহি জানি কারে তাই বলিবারে করে উতলা !
দখিন পবনে বিহ্বলা ধরা কাকলি কূজনে হয়েছে মুখরা ,
আজি নিখিলের বাণী মন্দিরে খুলেছে দ্বার।
ঞ)
স্তব্ধ হল দশ দিক নত করি আঁখি
বন্ধ করি দিল গান যত ছিল পাখি।
শান্ত হয়ে গেল বায়ু , জলকলস্বর
মুহূর্তে থামিয়া গেল বনের মর্মর
বনের মর্মের মাঝে মিলাইল ধীরে।
নিস্তরঙ্গ তটিনীর জনশূন্য তীরে
নিঃশব্দে নামিল আসি সায়াহ্নচ্ছায়ায়
নিস্তব্ধ গগনপ্রান্ত নির্বাক ধরায়।
সেইক্ষণে বাতায়নে নীরব নির্জন
আমাদের দুজনের প্রথম চুম্বন।
দিক – দিগন্তরে বাজি উঠিল তখনি
দেবালয়ে আরতির শঙ্খঘণ্টা ধ্বনি
অনন্ত নক্ষত্রলোক উঠিল শিহরি,
আমাদের চোখে এলো অশ্রুজল ভরি।
—-মানসী কাব্যগ্রন্থ , প্রথম চুম্বন
ট )
আজি এ নিরালা কুঞ্জে আমার অঙ্গ- মাঝে
বরণের ডালা সেজেছে আলোকমালায় সাজে।
নব বসন্তে লতায় লতায় পাতায় ফুলে
বাণী হিল্লোল উঠে প্রভাতের স্বর্ণকূলে,
আমার দেহের বাণীতে সে গান উঠিছে দুলে –
এ বরণগান নাহি পেলে মান মরিব লাজে।
ওহে প্রিয়তম , দেহে মনে মম ছন্দ বাজে।
অর্ঘ্য তোমার আনিনি ভরিয়া বাহির হতে ,
ভেসে আসে পূজা পূর্ণ প্রাণের আপন স্রোতে।
মোর তনুময় উছলে হৃদয় বাধনহারা ,
অধীরতা তারই মিলনে তোমারি হোক না সারা।
ঘন যামিনীরে আঁধারে যেমন জ্বলিছে তারা,
দেহ ঘেরি মম প্রাণের চমক তেমনি রাজে –
সচকিত এল নেচে উঠে মোর সকল কাজে।
ঠ ) ভীরুতা
গভীর শুরে গভীর কথা
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই।
মনে মনে হাসবি কিনা
বুঝব কেমন করে ?
আপনি হেসে তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই –
ঠাট্টা করে ওড়াই সখী,
নিজের কথাটাই।
হালকা তুমি কর পাছে ,
হালকা করি ভাই ,
আপন ব্যাথা টাই।
সত্য কথা সরল ভাবে
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই।
অবিশ্বাসে হাসবি কিনা
বুঝবো কেমন করে ?
মিথ্যা ছলে তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই,
উল্টা করে বলি আমি
সহজ কথা টাই।
ব্যর্থ তুমি কর পাছে
ব্যর্থ করি ভাই
আপন ব্যাথাটাই।
সোহাগ ভরা প্রাণের কথা
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই।
সোহাগ ফিরে পাবো কিনা
বুঝবো কেমন করে ?
কঠিন কথা তাই শুনিয়ে দিয়ে যাই
গর্ব ছলে দীর্ঘ করি নিজের কথাটাই।
ব্যাথা পাচ্ছে না পাও তুমি
লুকিয়ে রাখি তাই
নিজের ব্যাথা টাই।
(সংক্ষেপিত ————- কাব্যগ্রন্থ ক্ষণিকা)