৪ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের জন্য কতগুলি চিরকালীন সেরা কবিতা (ছোটদের আবৃত্তির কবিতা)
ছোটদের ছড়া ও কবিতার কিছু এখানে তুলে ধরা হলো, পরবর্তীতে আরও সংযোজিত হবে
আকাশ ঘিরে মেঘ করেছে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আকাশ ঘিরে মেঘ করেছে
সূয্যি গেছে পাটে।
খুকু গেলো জল আনতে
পদ্ম দীঘির ঘাটে।
পদ্মদীঘির কালো জলে
হরেকরকম ফুল।
হাঁটুর নিচে দুলছে খুকুর
গোছা ভরা চুল।
আমার পণ – মদনমোহন তর্কালঙ্কার
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে
আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।
ভাইবোন সকলেরে যেন ভালোবাসি
একসাথে থাকি যেন সবে মিলিমিশি
ভালো ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা
পাঠ এর সময় যেন নাহি করি হেলা
সুখী যেন নাই হই আর কারও দুঃখে
মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে
সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি
কিছুতে কাহারে যেন নাহি দিই ফাঁকি
ঝগড়া না করি যেন কভু কারও সনে
সকালে উঠিয়া এই বলি মনে মনে।
নোটন নোটন পায়রা গুলি
নোটন নোটন পায়রা গুলি
ঝোটন বেঁধেছে
ও পাড়াতে ছেলেমেয়ে
নাইতে নেমেছে।
কে দেখেছে কে দেখেছে
দাদা দেখেছে
দাদার হাতে কলম ছিল
ছুড়ে মেরেছে।
উঃ বড্ডো লেগেছে
কাজের লোক – নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
মৌমাছি মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই।
ওই ফুল ফুটে বনে
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় তো নাই।
ছোটপাখি ছোটপাখি
কিচিমিচি ডাকি ডাকি
কোথা যাও বলে যাও শুনি।
এখন না কব কথা
আনিয়াছি তৃণলতা
আপনার বাসা আগে বুনি।
পিপীলিকা পিপীলিকা
দলবল ছাড়ি একা
কোথা যাও যাও ভাই বলি।
শীতের সঞ্চয় চাই
খাদ্য খুঁজিতেছি তাই
ছয় পায়ে পিলপিল চলি।
এতো হাসি কোথায় পেলে – জসীমউদ্দীন
এতো হাসি কোথায় পেলে
এতো কথার কলকলানি
কে দিয়েছে মুখ টি ভরে
কোন বা গাঙ এর কলকলানি।
কে দিয়েছে রঙিন ঠোঁটে
কলমি ফুল এর গুলগুলানি।
কে দিয়েছে চলন বলন
কোন সে লতার দুলদুলানি।
কাদের ঘরে রঙিন পুতুল
আদরে যে টইটুবানি।
কে এনেছে বরণ ডালায় পাটের
বনের বউটুবানি।
কাদের পাড়ায় ঝামুর ঝুমুর
কাদের আদর গড়পড়ানি
কাদের দেশের কোন সে চাঁদের
জোছনা ফিনিক ফুল ছড়ানি।
তোমায় আদর করতে আমার
মন যে হল উড়উড়ানি
উড়ে গেলাম সুরে পেলাম
তোমার কথার গড়গড়ানি।
পালের নাও – জসীমউদ্দীন
পালের নাও পালের নাও, পান খেয়ে যাও
ঘরে আছে ছোট্ট বোনটি, তারে নিয়ে যাও
কপিল শাড়ি গাই এর দুধ যেয়ো পান করে,
কৌটো ভারী সিঁদুর দেব কপাল টি ভরে
গুঁড়ার গায়ে ফুলচন্দন দেব ঘষে ঘষে
মামারবাড়ির বলবো কথা শুনো বসে বসে.
খিচুড়ি – সুকুমার রায়
হাঁস ছিল সজারু (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেলো হাঁসজারু কেমনে তা জানিনা।
বক কহে কচ্ছপে “বাহবা কি ফূর্তি”!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।
টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারী শঙ্কা
পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা?
ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি,
চাপিল বিছার ঘাড়ে ধরে, মুড়ো সন্ধি!
জিরাফ এর সাধ নাই মাঠে ঘাটে ঘুরিতে,
ফড়িং এর ঢং ধরি সেও চায় উড়িতে।
গরু বলে “আমারেও ধরিল কি ও রোগে?”
মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে?
হাতিমীর দশা দেখ – তিমি ভাবে জলে যাই,
হাতি বলে “এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই।”
সিংহের সিং নেই এই তার কষ্ট –
হরিনের সাথে মিলে সিং হলো পস্ট।
প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি – সুকুমার রায়
প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি
খাসা তোর চেঁচানি !
শুনে শুনে আনমন
নাচে মোর প্রাণ মন !
মাজা গলা চাঁচাঁ সুর
আহলাদে ভরপুর !
গলা চেরা গমকে
গাছপালা চমকে ,
সুরে সুরে কত প্যাঁচ
গিটকিরি ক্যাঁচ ক্যাঁচ!
যত ভয় যত দুখ
দুরু দুরু ধুক ধুক,
তোর গানে পেঁচি রে
সব ভুলে গেছি রে –
চাঁদ মুখে মিঠে গান
শুনে ঝরে দু নয়ান
বাবুরাম সাপুড়ে – সুকুমার রায়
বাবুরাম সাপুড়ে ,
কোথা যাস বাপুরে ?
আয় বাবা দেখে যা ,
দুটো সাপ রেখে যা !
যে সাপের চোখ নেই ,
সিং নেই নখ নেই ,
ছোটে না কি হাঁটে না ,
কাউকে যে কাটে না ,
করে নাকো ফোঁস ফোঁস ,
মারে নাকো ঢুশ ঢাশ ,
নেই কোনো উৎপাত
খায় শুধু দুধ ভাত –
সেই সাপ জ্যান্ত
গোটা দুই আনতো?
তেড়ে মেড়ে ডান্ডা
করে দি ঠান্ডা।
কাতুকুতু বুড়ো – সুকুমার রায়
আর যেখানে যাও নারে ভাই সপ্তসাগর পার,
কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার !
সর্বনেশে বৃদ্ধ সে ভাই যেও না তার বাড়ি –
কাতুকুতুর কুলপি খেয়ে ছিড়বে পেটের নাড়ি।
কোথায় বাড়ি কেউ জানেনা, কোন সড়কের মোড়ে,
একলা পেলে জোর ক’রে ভাই গল্প সোনায় প’ড়ে।
বিদঘুটে তার গল্প গুলো না জানি কোন দেশী,
শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি।
না আছে তার মাথা মুন্ড, না আছে তার মানে,
তবুও তোমায় হাসতে হবে, তাকিয়ে বুড়োর পানে।
কেবল যদি গল্প বলে তাও থাকা যায় সয়ে ,
গায়ের উপর সুড়সুড়ি দেয় লম্বা পালক লয়ে।
কেবল বলে “হো হো হো, কেষ্ট দাস এর পিসি —
বেচতো খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম্ আর তিসি।
ডিম্ গুলো সব লম্বা মতন, কুমড়ো গুলো বাঁকা ,
কচুর গায়ে রংবেরং এর আল্পনা সব আঁকা।
অষ্টপ্রহর গাইতো পিসি আওয়াজ করে মিহি ,
ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও বাকুম বাকুম ভৌ ভৌ ভৌ চিঁহি।
এই না বলে কুটুৎ করে চিমটি কাটে ঘাড়ে ,
খ্যাংরা মতন আঙ্গুল দিয়ে খোঁচায় পাঁজর হাড়ে।
তোমায় দিয়ে সুড়সুড়ি সে আপনি লুটোপুটি ,
যতক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছু তে নাই ছুটি।
দুঃখহারী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মনে করো তুমি থাকবে ঘরে
আমি যেন যাবো দেশান্তরে।
ঘাটে আমার বাঁধা আছে তরী,
জিনিসপত্র নিয়েছি সব ভরি–
ভালো করে দেখ তো মনে করি
কি এনে মা, দেব তোমার তরে।
চাস কি মা, তুই এত এত সোনা-
সোনার দেশে করবো আনাগোনা।
সোনামতী নদী- তীরের কাছে
সোনার ফসল মাঠে ফলে আছে,
সোনার চাঁপা ফোটে সেথায় গাছে –
না কুড়িয়ে আমি তো ফিরব না।
পরতে কি চাস মুক্ত গেঁথে হারে –
জাহাজ বেয়ে যাবো সাগর পারে।
সেখানে মা সকাল বেলা হলে
ফুলের পরে মুক্ত গুলি দোলে –
টুপটুপিয়ে পড়ে ঘাস এর কোলে –
যত পারি আনব ভারে ভারে।
দাদার জন্য আনব মেঘে ওড়া
পক্ষিরাজের বাচ্চা দুটি ঘোড়া।
বাবার জন্যে আনব আমি তুলি
কনক লতার চারা অনেক গুলি-
তোর তরে মা দেব কৌটা খুলি
সাত রাজার ধন মানিক একটি জোড়া।
সুখদুঃখ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বসেছে আজ রথের তোলাই স্নান যাত্রার মেলা।
সকাল থেকে বাদল হল, ফুরিয়ে এলো বেলা।
আজকে দিনের মেলামেশা ,
যত খুশি, ততই নেশা ,
সবার চেয়ে আনন্দময় ওই মেয়েটির হাসি-
এক পয়সায় কিনেছে ও তালপাতার এক বাঁশি।
বাজে বাঁশি পাতার বাঁশি আনন্দস্বরে
হাজার লোকের হর্ষধ্বনি সবার উপরে।
ঠাকুরবাড়ি ঠেলাঠেলি লোকের নাহি শেষ,
অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ধারায় ভেসে যায় রে দেশ।
আজকে দিনের দুঃখ যত
নাইরে দুঃখ উহার মতো
ওই যে ছেলে কাতর চোখে দোকান পানে চাহি –
একটি রাঙা লাঠি কিনবে একটি পয়সা নাহি।
চেয়ে আছে নিমেষ হারা নয়ন অরুন
হাজার লোকের মেলাটিকে করেছে করুণ।
আমাদের পাড়া – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি
আছে আমাদের পাড়াখানি।
দীঘি তার মাঝখান টিতে
তালবন তারি চারি ভিতে।
বাঁকা এক সরু গলি বেয়ে
জল নিতে আসে যত মেয়ে।
বাঁশ গাছ ঝুঁকে ঝুঁকে পরে,
ঝুরু ঝুরু পাতাগুলি নড়ে।
পথের ধারেতে একখানে
হরিমুদি বসেছে দোকানে।
চাল ডাল বেচে তেল নুন,
খয়ের সুপারি বেচে চুন।
ঢেঁকি পেতে ধান ভানে বুড়ি ,
খোলা পেতে ভাজে খই মুড়ি।
বিধু গয়লানী মায়েপোয়ে
সকাল বেলায় গরু দোয়।
আঙিনায় কানাই বলাই
রাশি করে সরিষা কলাই।
বড়োবউ মেজোবউ মিলে
ঘুঁটে দেয় ঘরের পাঁচিলে।