সূচিপত্র
কোলেস্টেরল কি?
কোলেস্টেরল হল তেল জাতীয় বা চর্বিজাতীয় পদার্থ যা আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ এর গঠনের জন্য এবং তাদের ভালোভাবে কাজ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান।
তাই রক্তে কোলেস্টেরল মানেই যে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক তা একেবারেই নয়। বরং আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ তৈরীর জন্য এবং ভিটামিন, হরমোন তৈরী হবার জন্য কোলেস্টেরল একান্ত প্রয়োজন।
তাহলে সমস্যা কোথায় ?
আসলে আমাদের শরীরে রক্তে কোলেস্টেরল এর উৎস – দুই টি। আমাদের লিভার বা যকৃৎ আমাদের শরীরের জন্য যতটুকু কোলেস্টেরল দরকার তা বানিয়ে নেয়, তাই লিভার হলো প্রথম উৎস।
গন্ডগোল হলো দ্বিতীয় উৎস নিয়ে। সেটি হলো আমাদের জিভের লোভ ও অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস।
অত্যাধিক পরিমানে প্রাণীজ খাদ্য উপাদান যেমন মাংস, ডিম্, পোল্ট্রি প্রোডাক্টস, ডেয়ারি প্রোডাক্টস খেলে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল আমাদের শরীরে ঢোকে ও রক্তের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে থাকে এবং স্বাভাবিক ভাবেই রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা বেড়ে যায়।
মাংস, ডিম্, পোল্ট্রি প্রোডাক্টস, ডেয়ারি প্রোডাক্টসে থাকে কিছু স্যাচুরেটেড ও ট্রান্স ফ্যাট যা কিনা লিভারকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কোলেস্টেরল তৈরী করতে বাধ্য করে।
বেশ কিছু ভোজ্য তেল; যেমন পাম তেল, নারকেল তেল প্রভৃতির মধ্যে বিভিন্ন ধরণের স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যা রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
আর যেহেতু বেশিরভাগ কেক বা ডেয়ারি পণ্য তে তেল ব্যবহার করা হয় তাই ডেয়ারি প্রোডাক্টস ও কোলেস্টেরল বাড়াতে পারে। ( মনে পড়ছে কি যে পাউরুটি, কেক, ভালো বিস্কিট খেলে হাত কত তেলতেলে হয়ে যায় ?)
কোলেস্টেরল কি, কোলেস্টেরল কেন হয় , সে তো জানা গেলো এবার জানা যাক
কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি কেন ?
কোলেস্টরল ২ ধরণের হয়, যারা রক্তের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। একটি হলো HDL কোলেস্টরল ও অন্যটি হলো LDL কোলেস্টরল।
LDL – লো ডেনসিটি লিপো প্রোটিন। এটি হলো শরীরের জন্য ক্ষতিকর কোলেস্টেরল।
HDL – হাই ডেনসিটি লিপো প্রোটিন। এটি হলো শরীরের জন্য ভালো কোলেস্টেরল।
ব্লাড টেস্ট করা হয় রক্তে HDL ও LDL এর পরিমান জানার জন্য।
LDL কোলেস্টেরল / ক্ষতিকর কোলেস্টেরল – এই জাতীয় কোলেস্টেরল খারাপ কারণ এরা রক্তনালীর মধ্যে বিভিন্ন চর্বিজাতীয় পদার্থ জমা করতে থাকে বা জমা হতে থাকে তাই রক্তনালী/ blood vessel এর মধ্যে দিয়ে রক্ত যাবার জায়গা কমতে থাকে তাই রক্ত চাপ বাড়ে এবং যদি কোনো ভাবে একটি রক্তনালীর মধ্যে দিয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তাহলেই হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হবার সম্ভাবনা দেখা যায়।
HDL কোলেস্টেরল – HDL কোলেস্টেরল হলো সেই ধরণের কোলেস্টেরল যারা খারাপ কোলেস্টেরল অর্থাৎ LDL কোলেস্টেরল কে রক্তনালীর মধ্যে থেকে টেনে বের করে নিয়ে যায় লিভারে যেখানে এই খারাপ LDL কোলেস্টেরল গুলি ভেঙে গিয়ে শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে ফলে রক্ত নালীর গায়ে LDL কোলেস্টেরল জমে যাওয়া কে আটকায় এই HDL কোলেস্টেরল।
কিন্তু HDL কোলেস্টেরল সম্পূর্ণ রূপে LDL কোলেস্টেরল কে রক্ত থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেনা, শুধুমাত্র রক্তের LDL কোলেস্টেরলের এক এর তৃতীয়াংশই তাড়াতে সক্ষম।
কোলেস্টেরল কমানোর উপায় কি ?
প্রধান উপায় হলো – ১) জিভের লালসা কে সংবরন, ২) আত্ম নিয়ন্ত্রণ ও ৩) দৈনিক কায়িক পরিশ্রম।
রোজ ভাজাভুজি, তেলেভাজা, অত্যধিক তেল মশলা দিয়ে রান্না খবর পরিত্যাগ করতেই হবে, কারণ আমাদের দৈনিক জীবনযাত্রা এমন ই বাজে জায়গায় পৌঁছে গেছে যে রোজগার কাজকর্মে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও শরীরের যে পরিমান খাবার আমরা ঢোকাচ্ছি তা বার্ন আউট করতে পারছিনা।
তাই কায়িক পরিশ্রমের অভাবে তেলেভাজার তেল রক্তনালীর গায়েই এঁটে বসছে এবার তাকে সরাতে ওষুধ খেতেই হবে!
তাই নিয়ন্ত্রণ রাখুন খাবার অভ্যাসের উপর।(চপের দোকানির সংসার চললো কি চললো না তা দেখার দায় আপনার নয়।)
প্রতিদিন অন্ত আধা ঘন্টা হাঁটুন, শুয়ে বসে থাকা চলবেনা, শরীরে ইচ্ছে না হলেও রাস্তায় বের হন, গৃহবধূরা বেশি করে সচেতন হোন , বাড়ির কাজে যে পরিশ্রম হয় তাতে ক্লান্তি আসে ঠিকই কিন্তু ক্যালোরি বার্ন আউট হয় না।
তাই বিশ্বাস করুন হাঁটতে আপনাকে হবেই , সমস্ত কাজ সামলেও অবশ্যই রোজ হাঁটতে যান।
কোলেস্টেরল কমানোর খাদ্য তালিকা
কি কি খাবেন না –
তেলেভাজা জাতীয় খাবার খাওয়া যাবেনা , কারণ এই সব খাবার বানাতে হাইড্রোজেনেটেড তেল ব্যবহার করা হয় যাতে LDL কোলেস্টেরল/ ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এর মাত্রা রক্তে বেড়ে যায়।
কেক, প্যাস্ট্রি, সফটড্রিংক খাওয়া এড়িয়ে চলুন। এগুলিতে প্রচুর পরিমান added সুগার থাকে যা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এর পরিমান বাড়িয়ে দেয়।
ডিমের কুসুম বাদ দিয়ে খাবার চেষ্টা করুন অর্থাৎ শুধু সাদা অংশ খান, খুব সমস্যা হলে সপ্তাহে ২-৩ টি ডিম্ কুসুম সহ খেতে পারেন।
রেড মিট খাওয়া এড়িয়ে চলুন। মাসে ১ বার বা ২ মাসে একবার খাওয়া যেতে পারে। প্রসেসেড মাংস খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
ফুল ফ্যাট মিল্ক, ডেয়ারি প্রোডাক্ট খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করুন, রোজ একেবারেই খাবেন না।
মাখন-ঘি সপ্তাহে কদিন খেতে পারেন ? (সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করাই ভালো কারণ আমরা ইতিমধ্যেই যা যা খাবার খাই রোজ তার মধ্যে যথেষ্ট পরিমান ফ্যাট আছে )।
সাদা ময়দা, ময়দার পাউরুটি এড়িয়ে চলুন বা কম খান।
কি কি খাবেন –
শাক – সবজি পর্যাপ্ত পরিমানে খান কারণ সবজির মধ্যে এমন গুণ আছে যাতে শরীর থেকে খারাপ কোলেস্টেরল কে বের করে দিতে পারে।
ফল খান প্রতিদিন অন্তত যে কোনো একটা। ভিটামিন সি যুক্ত ফল বা সবজি রোজের খাবারে রাখুন।
মাছ হলো এমন একটি খাবার যা আমাদের শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল কে নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাই রোজ মাছ খাওয়া শরীরের জন্য ভালো। কোলেস্টেরল এর মাত্রা রক্তে কমিয়ে রাখতে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আছে এরকম মাছ ও খেতে পারেন।
আটার রুটি, পাউরুটি খান।
কোলেস্টেরল থেকে মুক্তির উপায় /রক্তে কোলেস্টেরল কমানোর উপায়-
খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করুন। উপরের তালিকা অনুযায়ী খাবার খান ও হাঁটাহাঁটি করুন, কায়িক পরিশ্রম করুন।
কোলেস্টেরল এর লক্ষন কি কি?
কোলেস্টেরল এমন পদার্থ নয় যে রাতারাতি তা রক্তে বেড়ে গিয়ে প্রাণ নাশ ঘটাতে সক্ষম হয়ে যায়।
কোলেস্টেরল খুবই আস্তে আস্তে বাড়ে আর সেই অর্থে কোনো লক্ষন ও প্রকাশ পায় না, যদিও চোখের তলায় বা উপরে হলুদ আস্তরণ জমা, ফোলা ভাব দেখা যায় কারোর কারোর ক্ষেত্রে।
কোলেস্টেরল বাড়লে ত্বকের উপর তার প্রভাব বোঝা যায় বলে বহু জায়গায় উল্লেখ থাকলেও সত্যি টা হলো কোলেস্টেরল বাড়ার কোনো symptoms দেখা যায়না।
কোলেস্টেরল রক্তে বাড়ছে কিনা তা জানতে বছরে ২ বার রক্ত পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ডাক্তাররা।
এছাড়াও যাদের থাইরয়েড এর সমস্যা থাকে তাদের রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রাও বাড়ার প্রবণতা থাকে।
কোলেস্টেরল এর ঔষধ-
কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ খেয়ে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকলেই যে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া যাবে এরকম নয়, তাই ওষুধ খাবেন কিনা বন্ধ করবেন সেই সিদ্ধান্ত আপনার ডাক্তার নেবেন।
অনলাইন সাইট দেখে ওষুধের ডোজ নির্ধারিত করা যাবেনা। যাদের ইতিমধ্যেই স্ট্রোক হয়ে গেছে তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত ডাক্তার বাবুরা ওষুধ বন্ধ করেন না কারণ ওষুধ বন্ধ করলে যদি কোলেস্টেরল রক্তনালীর গায়ে জমে আবার হার্ট attack হয় সেই ভয় এড়াতে।
কোলেস্টেরল কমানোর হোমিও ঔষধ
Guatteria gaumeri, Cholesterinum, Glysarrhzia glabra, Chelidonium, Lycopodium, Morgan gaertner, Baryta Muriaticum, Syzygium Jambolanum, Calcarea Carbonica ইত্যাদি। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া যাবে না।-
তথ্যসূত্র – 5 Best Homeopathic Medicine for Cholesterol
কোলেস্টেরল এর ঔষধ কি সারা জীবন খেতে হয় ?
বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে রক্তে কোলেস্টেরল বাড়ার কারণ বিভিন্ন, কারোর ক্ষেত্রে তা জেনেটিক, কারোর ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, স্থুলত্ব ইত্যাদি।
কোলেস্টেরল বাড়ার কারণ অনুযায়ী ডাক্তার বাবুরা ঠিক করবেন যে রোগী ওষুধ চালিয়ে যাবেন কিনা। যদি কোলেস্টেরল হালকা বেড়ে থাকে আর খাবার নিয়ন্ত্রণ ও জীবন যাপনের মাধ্যমে তা কন্ট্রোল করা যেতে পারে বলে ডাক্তারবাবুর মনে হয় তাহলে ডাক্তারবাবুই আপনাকে পরামর্শ দেবেন যে আপনি বন্ধ করবেন কিনা।
সুগার কমানোর ঘরোয়া উপায়গুলি কি কি?
পালস অক্সিমিটার কি? তার ব্যবহার ও গুরুত্ব