পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা ব্লকের নয়া গ্রাম শিল্প, ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য মিলনস্থল।
এই গ্রামটি পটচিত্র শিল্পের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে, যেখানে শিল্পীরা কাপড়ের স্ক্রলে রঙ-তুলির জাদুতে ফুটিয়ে তোলেন পুরাণ-ইতিহাসের গল্প।
কলকাতা থেকে প্রায় ১৩০ কিমি দূরবর্তী এই গ্রামে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে দেওয়ালজুড়ে রঙিন পটচিত্র, আর শোনা যাবে পটুয়াদের কণ্ঠে গাথা।
অবস্থান ও ইতিহাস
নয়া গ্রাম পিংলা ব্লকের অধীনস্থ একটি ছোট্ট গ্রাম, যার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কংসাবতী নদী।
১৮০০ শতকের শেষদিকে এখানে পটুয়া সম্প্রদায়ের বসতি গড়ে ওঠে। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বর্ণিত বিশ্বকর্মার বংশধররা এখানে পটচিত্রের প্রচলন করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শিল্প হয়ে ওঠে গ্রামবাসীর প্রধান জীবিকা।
১৯৯০-এর দশকে এই শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে থাকলেও ২০১০ সালে কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা “বাংলা নাটক ডট কম” ও “চিত্রতরু“র যৌথ উদ্যোগে প্রথম পটমেলার আয়োজন করা হয়। এরপর থেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি পায় নয়া গ্রাম।
পিংলার নয়া গ্রামের পটচিত্র শিল্প: ইতিহাস ও ঐতিহ্য

পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা ব্লকের নয়া গ্রামে পটচিত্র শিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশ বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। এই শিল্পের শিকড় প্রোথিত রয়েছে পুরাণ, লোককথা ও সামাজিক প্রথার গভীরে।
পুরাণ ও ঐতিহাসিক উৎস
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে, বিশ্বকর্মার বংশধর চিত্রকর সম্প্রদায়ের হাত ধরে পটচিত্রের সূচনা। স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, ফকির পটুয়া নামক এক দল শিল্পী নরখাদক দৈত্যকে ছবি এঁকে বোকা বানিয়ে পরাজিত করেছিলেন। এই ঘটনা থেকে পটুয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব বলে বিশ্বাস করা হয়।
মধ্যযুগীয় বিকাশ
১৩শ শতক থেকে পটুয়ারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে গীতিকাব্য ও পৌরাণিক কাহিনি (বেহুলা-লক্ষীন্দর, চণ্ডীমঙ্গল) বর্ণনা করতেন লম্বা কাপড়ের স্ক্রোলে (গোটানো পট) আঁকা ছবি দেখিয়ে। তাদের গানকে বলা হত “পটের গান” বা “পটুয়া সঙ্গীত”। বিনিময়ে শ্রোতারা চাল-ডাল বা টাকা দিতেন।
উপকরণ ও শৈলী
- ক্যানভাস: প্রাচীনকালে জুট ফাইবার, পরবর্তীতে হস্তচালিত মলমল কাপড়।
- রং: প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রস্তুত (হলুদ গাছ, শিলাখাতুই, ধোঁয়া)।
- বিষয়বস্তু: ১৫-২০টি ফ্রেমে রামায়ণ-মহাভারত, সামাজিক বার্তা ও সমসাময়িক ঘটনা।
আধুনিক পতন ও পুনর্জাগরণ
১৯৯০-এর দশকে এই শিল্প প্রায় বিলুপ্তির মুখে ছিল। ২০১০ সালে বাংলা নাটক ডট কম ও চিত্রতরু সংস্থার যৌথ উদ্যোগে প্রথম পটমেলা আয়োজনের মাধ্যমে নতুন প্রাণ ফিরে পায়। বর্তমানে গ্রামের ৭০টি পরিবারের ২৫০+ শিল্পী (নারী-পুরুষ-শিশু সমেত) এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।
বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য
- গীতিনাট্য শিল্প: পটুয়ারা একইসাথে চিত্রশিল্পী, গায়ক ও অভিনেতা।
- সমকালীন প্রতিফলন: কোভিড-১৯, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ও এখন পটচিত্রে স্থান পায়।
- আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: ইউনেস্কো কর্তৃক ২০২১ সালে “অদৃশ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” তালিকায় অন্তর্ভুক্তি।
সাংস্কৃতিক প্রভাব
নয়া গ্রামের প্রতিটি দেওয়াল আজ জীবন্ত গ্যালারি। এখানকার শিল্পীরা শুধু পট আঁকেন না, বরং মাস্ক, হ্যান্ডপেইন্টেড টেক্সটাইল ও ম্যুরাল তৈরিতেও দক্ষ।
কলকাতার কালীঘাট পটচিত্র ও ওড়িশার রঘুরাজপুর শৈলী থেকে এদের শিল্প ভিন্ন, কারণ এখানে গান-কথার মাধ্যমে গল্প বলা প্রধান
