নিখুঁতি: এক ঐতিহ্যবাহী বাঙালি মিষ্টি

by

নিখুঁতি পশ্চিমবঙ্গের এক জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি, যা বাঙালি মিষ্টান্ন ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন।

এই লম্বাটে, পান্তুয়া-ধর্মী মিষ্টিটি তার শক্ত বাইরের স্তর ও নরম ভেতরের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।

স্বাদের পাশাপাশি নিখুঁতি পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ করে শান্তিপুর ও তার আশেপাশের অঞ্চলে সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে।

নিখুঁতির উৎপত্তি ও আঞ্চলিক গুরুত্ব

নিখুঁতি (কখনও নিখুতি বা নিকুতি হিসেবেও লেখা হয়) পশ্চিমবঙ্গের এক বিশেষ মিষ্টি।

যদিও এটি রসগোল্লা বা সন্দেশের মতো সর্বভারতীয় পরিচিতি পায়নি, তবুও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এর আলাদা কদর রয়েছে।

বিশেষ করে নদীয়া জেলার শান্তিপুরে নিখুঁতি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এছাড়া জনাই, কৃষ্ণনগর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার নিখুঁতিও স্বতন্ত্র স্বাদ ও গুণাগুণের জন্য বিখ্যাত।

২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শান্তিপুরের নিখুঁতিকে পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে তুলে ধরেছিল, যা এই মিষ্টির সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং তার পর্যটন সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে।

গঠন ও বৈশিষ্ট্য

নিখুঁতি মূলত পান্তুয়া পরিবারের সদস্য। এর আকৃতি লম্বাটে, অনেকটা ল্যাংচার মতো।

তবে নিখুঁতির বিশেষত্ব হল-এর বাইরের স্তরটি শক্ত এবং ভেতরটা নরম ও স্যাঁতসেঁতে। আকারে এটি পান্তুয়া বা ছানার জিলিপির চেয়ে ছোট হয়।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, কিছু সময়ে পরিবেশনের সময় নিখুঁতির ওপরে সামান্য গোলমরিচ গুঁড়ো ছিটিয়ে দেওয়া হয়, যা মিষ্টির স্বাদের সঙ্গে এক অনন্য ঝাঁঝালো অনুভূতি যোগ করে।

এই বৈশিষ্ট্যটি নিখুঁতিকে অনেক বাঙালি মিষ্টির থেকে আলাদা করে তোলে।

নিখুঁতি

নিখুঁতির উপকরণ ও প্রস্তুত প্রণালী

নিখুঁতি তৈরিতে সাধারণত নিচের উপকরণগুলি ব্যবহৃত হয় –

  • গরুর দুধের ছানা (প্রয়োজনে মহিষের দুধও ব্যবহার করা যায়)
  • সুজি
  • ময়দা
  • বেকিং সোডা
  • দুধ
  • ঘি বা স্পষ্টিত মাখন
  • চিনি (সিরার জন্য)
  • এলাচ (সিরার স্বাদ বৃদ্ধির জন্য)

প্রস্তুত প্রণালী:

১. প্রথমে দুধ থেকে ছানা বানিয়ে নিতে হয় (লেবুর রস বা ভিনেগার দিয়ে দুধ ফেটিয়ে)।
২. ছানাটি ভালোভাবে ৮-১০ মিনিট মথে নিতে হয়, যাতে এটি মসৃণ হয়।
৩. এরপর ছানার সঙ্গে সুজি, ময়দা, বেকিং সোডা, ঘি ইত্যাদি মিশিয়ে মন্ড তৈরি করতে হয়।
৪. মন্ড থেকে ছোট ছোট অংশ নিয়ে হাতের তালুতে লম্বাটে আকারে গড়ে নিতে হয়।
৫. এই বলগুলি ঘিয়ে বা তেলে ভেজে নেওয়া হয়, যাতে বাইরের অংশ শক্ত হয়।
৬. ভাজা বলগুলি এলাচ দেওয়া চিনির সিরায় ডুবিয়ে রাখা হয়।

চিনির সিরা তৈরি করতে জলে চিনি গলিয়ে ফুটিয়ে নিতে হয়। সিরা ঘন হলে এলাচ দিয়ে স্বাদ বাড়ানো হয়।

পরিবেশন ও বৈচিত্র্য

প্রথাগতভাবে নিখুঁতি সরাসরি পরিবেশন করা হয়। তবে নিখুঁতির আরেকটি জনপ্রিয় রূপ হলো নিখুঁতির পায়েস, যেখানে নিখুঁতি দুধের পায়েসে ব্যবহার করা হয়।

বাড়িতে বা অনুষ্ঠানে সহজেই বেশি পরিমাণে বানানো যায়-উপকরণের পরিমাণ বাড়ালেই হয়। অনেকেই বলেন, নিখুঁতি এতই সুস্বাদু যে একটিতে মন ভরে না!

অনুরূপ মিষ্টির সঙ্গে তুলনা

নিখুঁতি পান্তুয়া ও ছানার জিলিপির সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়, সবগুলিতেই ছানা, সুজি, ময়দা, সিরা ব্যবহার হয়।

তবে আকৃতি, পরিবেশনের ধরন (গোলমরিচ গুঁড়ো ছিটানো) এবং স্বাদে নিজস্ব বৈচিত্র্য রয়েছে নিখুঁতির।

nikhuti 2

উপসংহার

নিখুঁতি বাঙালি মিষ্টান্ন শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন, যেখানে সাধারণ উপকরণকে নিপুণ হাতে অনন্য স্বাদ ও গঠনে রূপান্তরিত করা হয়।

শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে নিখুঁতির বিশেষ কদর রয়েছে।

এর স্বাদ, গঠন ও পরিবেশনের বৈচিত্র্য নিখুঁতিকে বাঙালি মিষ্টির জগতে এক বিশেষ অবস্থান এনে দিয়েছে।

নিখুঁতির উৎপত্তি নিয়ে বেশ কিছু আকর্ষণীয় কাহিনি ও জনশ্রুতি রয়েছে, যার বেশিরভাগই শান্তিপুরকে কেন্দ্র করে।

অধিকাংশ গবেষক ও স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, নিখুঁতির জন্ম শান্তিপুরেই।

প্রায় দুইশো বছর আগে, শান্তিপুরের ভো-ভাগাড় মোড়ে ছিল বিখ্যাত ময়রা ভোলা ময়রার দোকান।

তাঁর রূপবতী কন্যার নাম ছিল ‘নিখুঁতি’। একদিন বাবার অনুপস্থিতিতে নিখুঁতি ছানা আর ময়দার ডেলা পাকিয়ে, খেলাচ্ছলে তেলে ভেজে চিনির রসে ডুবিয়ে রাখে।

পরে দোকানে এক ক্রেতা এসে সেই নতুন ধরনের মিষ্টি খেয়ে মুগ্ধ হন এবং নাম জানতে চান।

ভোলা ময়রা কানে কম শুনতেন, তাই তিনি ভাবেন, ক্রেতা তাঁর মেয়ের নাম জানতে চাইছেন।

তিনি বলেন, “নিখুঁতি”। সেই থেকেই এই মিষ্টির নাম হয়ে যায় নিখুঁতি এবং এটি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।

এছাড়া, কেউ কেউ মনে করেন নিখুঁতির উৎপত্তি বোঁদে (বুন্দিয়া)-র থেকে হলেও, অধিকাংশ গবেষক এই তত্ত্ব মানেন না।

নিখুঁতির বিশেষত্ব, এর আকারে ল্যাংচার মতো লম্বাটে, বাইরের দিকটা শক্ত ও ভিতরটা নরম, এবং পরিবেশনের সময় উপরে গোলমরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দেওয়া হয়।

সারসংক্ষেপে, নিখুঁতির উৎপত্তি শান্তিপুরের ভোলা ময়রার কন্যা নিখুঁতির হাত ধরেই, এক আকস্মিক আবিষ্কার ও নামকরণের গল্পের মাধ্যমেই হয়েছে বলে স্থানীয় ইতিহাস ও জনশ্রুতি থেকে জানা যায়।

বাতাবি লেবুর উপকারিতা গুলি কি কি?

DMCA.com Protection Status

Spread the love

Leave a Comment

error: Content is protected !!