মার্টিন ট্রেন: বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য চিহ্ন

by

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

মার্টিন ট্রেন (Martin’s Light Railways) বাংলার লোকজীবনে এক ঐতিহাসিক স্মৃতি—ধীরগতির, ছোট কামরার, বাষ্প ইঞ্জিনচালিত এই ট্রেন এক সময় কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলির সঙ্গে দুর্গম গ্রামাঞ্চলকে যুক্ত করেছিল।

কলকাতার শহরতলির, হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগনা এবং বসিরহাট অঞ্চলের সাধারণ মানুষের যাতায়াত, কৃষিজ দ্রব্য, কুটির শিল্প, নারিকেল, কাঠ, মাদুর পরিবহনে এই ট্রেন ছিল অবিচ্ছেদ্য।

মার্টিন-ট্রেন

প্রতিষ্ঠা, লক্ষ্য ও বিস্তার

  • প্রতিষ্ঠা: ১৮৯৭-১৯১৪ সালে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী টমাস অ্যাকুইনাস মার্টিন এবং বাঙালি উদ্যোগপতি স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের যৌথ উদ্যোগে ‘Martin & Co’ গড়ে ওঠে—এরপর ‘Martin Light Railway’-এর সূচনা।
  • উদ্দেশ্য: কলকাতা শহর ও সংলগ্ন অঞ্চলের অব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগের উন্নতি।
  • বিস্তার: শুরুতে হাওড়া-আমতা, হাওড়া-শিয়াখালা, বারাসাত-বসিরহাট, হাসনাবাদ, শান্তিপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, বারুইপুর, এমনকি বিহার-উত্তরপ্রদেশেও এর শাখা বিস্তৃতি ছিল।

মুখ্য রুট ও উল্লেখযোগ্য স্থান

  • হাওড়া–আমতা শাখা: হাওড়া থেকে আমতা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পেও এই রেলের উল্লেখ রয়েছে।
  • হাওড়া–শিয়াখালা শাখা: যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধিতে ১৯০৮ সালে শ্যামবাজার শাখা-খোলা হয়।
  • বারাসাত–বসিরহাট: ১৯১৪ সালে বারাসাত থেকে হাসনাবাদ পর্যন্ত রেল চালু হয়।
  • শ্যামবাজার–হাসনাবাদ: শ্যামবাজার থেকে হাসনাবাদ, লাঙলপোতা, হাড়োয়াখোল, খড়িবেড়ি, আমিনপুর, বাগুইআটি, হাটিয়ারা, রাজারহাট, পাতিপুকুর, বেলেঘাটা, বেলেঘাটা-জংশন—সবই ছুঁয়ে চলত।

বিভিন্ন রুটের বিভিন্ন স্টেশন

আমতা ও হাওড়া রুটের স্টেশনগুলি –

আমতা – হরিশদাদপুর – পানপুর – জালালসী – দক্ষিণ মাজু – মাজু – মুন্সিরহাট – পাতিহাল – বড়গাছিয়া – দক্ষিণবাড়ি – ডোমজুড় – মাকড়দহ – কাটলিয়া – শলপ – বাঁকড়া – বালটিকুরী – দাশনগর – কদমতলা – হাওড়া ময়দান

বড়গাছিয়া ও চাঁপাডাঙ্গা রুটের স্টেশন গুলি ছিল –

বড়গাছিয়া
সীতাপুর
প্রসাদপুর
জাঙ্গীপাড়া
আঁটপুর
হাওয়াখানা
পিয়াসারা
চাঁপাডাঙ্গা

হাওড়া ও শিয়াখালা লাইনের স্টেশনগুলি ছিল –

হাওড়া
কদমতলা
কোনা/একসরা
বুলুহাটি
কালীপুর
চণ্ডীতলা
কলাছড়া
কৃষ্ণরামপুর
জঙ্গলপাড়া
মশাট
শিয়াখালা

বারাসত ও বসিরহাট মধ্যবর্তী স্টেশনগুলি ছিল –

কাজিপাড়া – কারিয়া – কদম্বগাছি – বহিরা কালীবাড়ি – সোঁদালিয়া – বেলেঘাটা রোড – লেবুতলা – ভাসিলা – হাড়োয়া রোড – কাঁকড়া মিরজানগর – মালতিপুর – ঘোবরাশ ঘোলা – চাঁপাপুকুর – ভ্যাবলা হল্ট।

যাত্রী ও মালবাহী পরিষেবা

  • যাত্রী পরিষেবা: ধীরগতির হলেও সহজলভ্য, গ্রাম অঞ্চলের মানুষের জীবনের অংশ ছিল।
  • মালবাহী ট্রেন: আলু,শাক-সব্জি, গুড়, কাঠ, পাট, মাছ, দুধ, কৃষিজ সামগ্রী, মাদুর—সবই শহরে পৌছত মার্টিন ট্রেনের মাধ্যমে।
  • গতি ও সময়: পাঁচ-কামরার, ধীরগতির; হাওড়া থেকে আমতা যেতে সাড়ে চার ঘণ্টা লাগত।

সামাজিক ও জনজীবনে প্রভাব

  • হাওড়া-হুগলি ও শহরতলি: ছাত্র, শ্রমজীবী, ব্যবসায়ী, কৃষক—সবাই এই রেলে চড়তেন। বহু কলেজ, স্কুল, বাজার গড়ে ওঠে এই লাইনের স্টেশনগুলিকে ঘিরে।

    (আমতার রামসদয় কলেজ ও কদমতলার নরসিংহ দত্ত কলেজ গড়ে ওঠার কারণ ও ছিল মার্টিন রেলের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা।)
  • গ্রামীণ জীবন: গ্রামাঞ্চলের পণ্য-পরিবহণ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন শক্তিশালী হয়।

মজার কাহিনি ও লোকগাথা

  • মন্থর গতি, নানা গল্প: যাত্রীদের অনেক গল্প, কেউ ট্রেনের কাছাকাছি গৃহস্থ বাড়ি থেকে জল খেয়ে আবার উঠতেন; কেউ দৌড়ে এসে ট্রেনে উঠতেন।

    মজার ছলে বলা হত, কেউ ঘুঁটে ট্রেনের গায়ে লাগিয়ে দিলে, ফেরার সময় শুকিয়ে যেত।

পতন ও অবসান

  • ক্রমহ্রাসমান গুরুত্ব: ১৯৫০-এর দশকে বাস, টেম্পো, মোটরগাড়ি সহজলভ্য এবং দ্রুত হয়ে উঠলে মার্টিন ট্রেন জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে।
  • সমস্যা: শ্রমিক অসন্তোষ, লোকসান, সরকারী অনিচ্ছা—সব মিলিয়ে ১৯৭০-৭১ সালে যোগাযোগ স্থবির হয়ে যায়, বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল।
  • পরিবর্তন: পরবর্তীতে ভারতীয় রেল কর্তৃক একই রুটে ব্রডগেজ লাইন এবং আধুনিক ট্রেন চালু হয়েছে।

ঐতিহাসিক স্মারক ও উল্লেখ

ডোমজুড়ের ড. কালীপদ দে র মাথার যন্ত্রণার জন্য – ‘আশ্চর্য মলম’ ছিল মার্টিন ট্রেনে বহুল বিক্রিত একটি পণ্য।

মার্টিন রেলের একজন কড়া টিকিট পরীক্ষক ছিলেন হাওড়া-ডোমজুড়-এর
বাসিন্দা সুখলাল বসু।

হাওড়া-আমতা শাখা থেকে মার্টিন রেল আঁটপুর যাওয়ার পর থেকেই ওখানে টেরাকোটার জন্য বিখ্যাত রাধাগোবিন্দজিউর মন্দিরে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল।

খাদ্যদ্রব্য: বিখ্যাত ছিল মাজু গ্রামের খই-চুর, এছাড়াও ফেরি হতো আমতার পান্তুয়া, ডোমজুড়ের তেলেভাজা, মাকড়দহের চা, জগৎবল্লভপুরের পান।

আমতার পানপুর থেকে প্রচুর পরিমাণে ডাব উঠত ট্রেনে এবং পাতিহাল থেকে প্রচুর পরিমাণ ঘুঁটে প্রত্যহ কদমতলায় যেত।

বাংলা সাহিত্যে: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর অভিযাত্রিক গ্রন্থে মার্টিন রেলে চড়ার বর্ণনা পাওয়া যায়।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের “বনভোজনের ব্যাপার” গল্পে প্যালারামের বয়ানে মার্টিন ট্রেনের কথা জানা যায়।

এছাড়া শিবরাম চক্রবর্তীর ‘হাওড়া-আমতা রেলের দুর্ঘটনা’ লেখাতেও এর উল্লেখ আছে।

আজও স্মৃতিতে: মন্থর গতির মার্টিন ট্রেন কারো বাড়ির সদর ছুঁয়ে, কারো গোয়ালঘর, কারো রান্নাঘরের পাশ ঘেঁসে, বা পুকুরধার দিয়ে ছুঁয়ে চলতো তাই আজও বহু মানুষের স্মৃতিতে, পারিবারিক-লোককথায়, হাস্য-রসের গল্পে “মার্টিন ট্রেন” অম্লান।

চলচ্চিত্রে: শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আমি বড়ো হব’, দীনেন গুপ্ত’র ‘’নূতন পাতা’ এবং বিখ্যাত ছবি ‘ধন্যি মেয়ে’ তে মার্টিন ট্রেন দেখা যায়।

“সব খেলার সেরা বাঙালীর এই ফুটবল” চিত্রায়িত হয়েছিল মার্টিন রেলের কামরায়।

তথ্যঋণ : নানান সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধ এবং প্রদীপ রঞ্জন রীত মহাশয় রচিত পুস্তক ‘মার্টিন রেলের ইতিবৃত্ত”।

DMCA.com Protection Status

Spread the love

Leave a Comment

error: Content is protected !!