চার বাংলা মন্দির: ইতিহাস, স্থাপত্য ও গুরুত্ব

by

চার বাংলা মন্দিরের ইতিহাস মূলত আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে নাটোরের (বর্তমানে বাংলাদেশে) রানি ভবানীর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এক অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন।

আজিমগঞ্জের বড়নগরে অবস্থিত এই মন্দিরগুলি বাংলার মন্দির স্থাপত্যের এক অপূর্ব উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

চার বাংলা মন্দিরে
AI দ্বারা নির্মিত চার বাংলা মন্দিরের ছবি

চার বাংলা মন্দির নির্মাণের ইতিহাস

১৭৫৫ সালের দিকে, পলাশীর যুদ্ধের ঠিক দুবছর আগে, ভাগীরথীর তীরে মুর্শিদাবাদের বড়নগরে এলেন নাটোরের রানি ভবানী।

তিনি চেয়েছিলেন গঙ্গার তীরে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে এবং দ্বিতীয় বারাণসী গড়ে তুলতে।

সেই উদ্দেশ্যেই ১৭৬০ সালের আশেপাশে বড়নগরে একের পর এক মন্দির নির্মাণ শুরু করেন।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, বড়নগরে রানি ভবানী প্রায় ১০৮টি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, যার অধিকাংশই এখন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

এই মন্দিরগুলির মধ্যে চারটি একচালা বাংলা স্থাপত্য রীতির মন্দির এক উঠান ঘিরে পাশাপাশি নির্মিত হয়-এদেরই একত্রে বলা হয় ‘চার বাংলা’ মন্দির।

এই মন্দিরসমূহ বাংলার গ্রামীণ ঘরের আদলে তৈরি (এক বাংলা বা দোচালা শৈলী), এবং টেরাকোটার কারুকাজে সমৃদ্ধ।

প্রতিটি মন্দিরেই তিনটি করে প্রবেশপথ এবং শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, উত্তরমুখী মন্দিরের টেরাকোটায় রামলীলা, কৃষ্ণলীলা, মৃগয়া ও শোভাযাত্রার দৃশ্য ফুটে উঠেছে; পশ্চিমদিকের মন্দিরে যুদ্ধের দৃশ্য, অন্য মন্দিরে সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখা যায়।

রানি ভবানীর সময়ে বড়নগর ছিল পূর্ব ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ও বন্দর।

এখানে কাঁসা-পিতলের ব্যবসা ছিল বিখ্যাত, এবং ডাচ, ওলন্দাজ, ইংরেজ বণিকরাও এখানে ব্যবসার জন্য আসতেন।

  • নির্মাতা: নাটোরের রানি ভবানী
  • নির্মাণকাল: আঠারো শতক (প্রায় ১৭৬০ সাল)
  • উদ্দেশ্য: শিবের উপাসনার জন্য নির্মিত চারটি পৃথক মন্দির, যেগুলিকে একত্রে “চার বাংলা” বলা হয়।
  • ঐতিহাসিক গুরুত্ব: এই মন্দিরগুলি বাংলার মন্দির স্থাপত্যের এক বিশেষ ধারা “এক বাংলা” শৈলীর অন্যতম উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য

  • মন্দির সংখ্যা: চারটি, প্রতিটি আলাদা স্থানে পাশাপাশি স্থাপিত।
  • স্থাপত্য শৈলী: এক বাংলা (দোচালা) ঘরের আদলে নির্মিত, যার ছাদ বাঁকানো এবং বাংলার গ্রামীণ ঘরের অনুকরণে তৈরি।
  • প্রবেশপথ: প্রতিটি মন্দিরে তিনটি প্রবেশপথ রয়েছে।
  • আকার: প্রায় ৩১ ফুট x ১৫-১৬.৫ ফুট।
  • শিল্পকর্ম: দুটি মন্দিরের বাইরের দেয়ালে টেরাকোটার অপূর্ব কারুকাজ, একটি মন্দিরে খোদাই করা প্লাস্টার, এবং একটিতে সাধারণ প্লাস্টার।
  • বিষয়বস্তু: টেরাকোটার প্যানেলে পৌরাণিক কাহিনি, দৈনন্দিন জীবন ও সামাজিক দৃশ্যাবলি ফুটে উঠেছে।

সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

  • আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI): চার বাংলা মন্দিরসমূহ ভারতের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্মারক হিসেবে তালিকাভুক্ত।
  • প্রাকৃতিক ঝুঁকি: গঙ্গা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে মন্দিরগুলি ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।

দর্শন ও যাতায়াত

  • কীভাবে যাবেন:
    • নিকটতম রেলস্টেশন: মুর্শিদাবাদ (হাওড়া, মুম্বই, চেন্নাই, আহমেদাবাদ ইত্যাদি শহর থেকে সংযুক্ত)
    • সড়কপথে: কলকাতা, বর্ধমান, মালদা, কৃষ্ণনগর, দুর্গাপুর প্রভৃতি শহর থেকে বাস ও ট্যাক্সি পরিষেবা সহজলভ্য
    • নিকটতম বিমানবন্দর: কলকাতা (প্রায় ১৯৫ কিমি দূরে)

বাংলার মন্দির স্থাপত্যে চার বাংলার গুরুত্ব

চার বাংলা মন্দির বাংলার চালা শৈলীর এক অনন্য নিদর্শন।

চালা মন্দির বাংলার গ্রামীণ ঘরের আদলে নির্মিত হয় এবং এই ধারার মধ্যে দোচালা, চারচালা, আটচালা, এক বাংলা, জোড় বাংলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বড়নগরের চার বাংলা মন্দির এই এক বাংলা শৈলীর সবচেয়ে বিখ্যাত ও সংরক্ষিত নিদর্শনগুলির অন্যতম।

চার বাংলা মন্দিরের আদলে AI কল্পিত ছবি
চার বাংলা মন্দিরের আদলে AI কল্পিত ছবি

সারাংশ

সংক্ষেপে, চার বাংলা মন্দির শুধু ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং বাংলার স্থাপত্য, ইতিহাস ও টেরাকোটা শিল্পের এক অমূল্য নিদর্শন, যা নাটোরের রানি ভবানীর ঐতিহাসিক দানশীলতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে

চার বাংলা মন্দিরের প্রতিটি বাংলার নাম কী?

চার বাংলা মন্দিরের প্রতিটি “বাংলা”-অর্থাৎ, চারটি মন্দিরের আলাদা আলাদা নাম বা উৎসর্গ-সংক্রান্ত নির্দিষ্ট নাম ঐতিহাসিক নথিতে উল্লেখ নেই।

তবে, প্রতিটি মন্দিরেই শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত এবং চারটি মন্দিরই একচালা বা দোচালা বাংলার ঘরের আদলে নির্মিত বলে জানা যায়।

এই চারটি মন্দির এক উঠান ঘিরে পাশাপাশি অবস্থিত এবং মূলত স্থাপত্যশৈলীর জন্যই একত্রে “চার বাংলা” নামে পরিচিত।

প্রতিটি মন্দিরের বৈশিষ্ট্য:

  • চারটি মন্দিরই শিবের উদ্দেশ্যে নির্মিত এবং প্রতিটিতে তিনটি করে শিবলিঙ্গ রয়েছে, অর্থাৎ মোট ১২টি শিবলিঙ্গের পুজো হয়।
  • মন্দিরগুলির মধ্যে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম-এই চারটি দিক ঘিরে অবস্থান।
  • মন্দিরগুলির স্থাপত্য ও টেরাকোটার কাজে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে-কোনোটিতে টেরাকোটা প্যানেল, কোনোটিতে খোদাই করা প্লাস্টার, আবার কোনোটিতে সাধারণ প্লাস্টার দেখা যায়।

চার বাংলা মন্দিরের প্রতিটি মন্দির আলাদা আলাদা কোনো ঐতিহ্যবাহী নাম বা দেবতার নামে উৎসর্গিত নয়; বরং স্থাপত্যশৈলীর কারণে এদের “চার বাংলা” বলা হয় এবং প্রতিটিই শিব মন্দির

তথ্য সূত্র – উইকিপিডিয়া, মুর্শিদাবাদ জেলার ওয়েবসাইট

রসগোল্লা: বাংলার সেরা মিষ্টির ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য

নিখুঁতি: এক ঐতিহ্যবাহী বাঙালি মিষ্টি

DMCA.com Protection Status

Spread the love

Leave a Comment

error: Content is protected !!